নারায়ণগঞ্জে কাটানো প্রথম কোরবানীর ঈদ

১৭৬৬ সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতা বিকন লাল পান্ডে, যিনি বেণুর ঠাকুর বা লক্ষী নারায়ণ ঠাকুর নামে অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিকট থেকে এ অঞ্চলের মালিকানা কিনে নিয়েছিলেন। তিনি প্রভু নারায়ণের সেবার ব্যয়ভার বহনের জন্য একটি উইলের মাধ্যমে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত মার্কেটকে দেবোত্তর সম্পতি হিসেবে ঘোষণা করেন। তাই পরবর্তীকালে এ স্থানের নাম হয় নারায়ণগঞ্জ। কালেক্টরেটের প্রারম্ভিক দলিল-দস্তাবেজে নারায়ণগঞ্জের নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। সূত্র: উইকিপিডিয়া 



নারায়নগঞ্জ জেলা শহরটি ঢাকার অতি নিকটতম শিল্পনগরী জেলা শহর। একসময় ১০০% হিন্দু অধ্যষিত প্রচ্যের ড্যান্ডিখ্যাত জেলাটিতে মোট ৩০ লক্ষ ৪৪ হাজার মানুষ বসবাস করে যার মাত্র ১,৪৪,১০৫ জন হিন্দু  বাস করে। বিভিন্ন স্থানের নাম যেমন,  নিতাইগঞ্জ, শিবু মার্কেট, কালীবাজার ইত্যাদি এমনকি জেলা শহরটির নামকরণ ও হিন্দু দেবতার নামে। চাকুরী সুত্রে আমি ১লা এপ্রিয় স্থায়ীভাবে বসাবাসের উদ্দেশ্য নিয়ে কলিগের ফ্ল্যাটে উঠি। এর আগে একবার এসেছিলাম পরীক্ষা ও ভাইবা দিতে। মাত্র তিন মাসের অভিজ্ঞতার আলোকে আমার এই ক্ষুদ্র লেখাটি পড়বেন।

আমার বাসা থেকে অফিসের দূরত্ব ৫ কিলোমিটারের। অফিসের একটি ভল্ব গাড়ীতেই আমাদের যাতায়াত তবে মাঝে মাঝে গাড়ী জ্যামে পড়লে অফিসে সঠিক সময়ে পৌঁছাতে আমরা বাস/ ইজিবাইকে যেতাম। এপ্রিল, মে,জুন পেরিয়ে যখন জুলাই মাস আসল হটাৎ দেখি রাস্তার দুই ধার দিয়ে বিশাল বিশাল তোরণ।
কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে ব্যানার পড়ে বুঝলাম এটা কোরবানি উপলক্ষে গরু-ছাগলের অস্থায়ী হাট। একে তো উচ্চ স্বরে  আযানের শব্দে আমার মস্তিষ্ক হিম হয়ে আসে দ্বিতীয়ত
মাইকের শব্দ যুক্ত হল। বাসা থেকে অফিস যাত্রা পথে এখনো অবদি একটা প্রাইমারি স্কুল আমার চোখে পড়েনি। বিপরীতে দেখেছি কয়েকশো মাদ্রাসা। ওলিতে গলিতে মাদ্রাসা।  বুঝতে বাকী রইল না আমি কোথায় অবস্থান করছি। শুনলাম ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে হেফাযত ইসলামের ঢাকা ঘেরাও কর্মসুচীতে নারায়ণগঞ্জের নাকি ছিল বিশাল অবদান। এই এলাকা থেকে অনেকেই নাকি সে রাতে বীরগতি লাভ লাভ করছে,মানে শহীদ হয়েছে।

এবার আসি ঈদের দিনে সকালের ঘটনার বর্ণনায়। আমার পাঁচতলা বাসার জানালা দিয়ে অনেক কিছুই নজরে পড়ে যায়।  অফিস বন্ধ তাই রাত জাগা সকলের ঘুম ভাঙল অাল্লা হু আকবর ধ্বনি ও নিরীহ গুরুর ক্রন্দনের শব্দে। নিদ্রা চোখে জানালা দিয়ে দেখলাম রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা ও দু'ধারের ড্রেন। লোকজনের হৈ চৈ, একদল হুজুরের ছোটাছুটি হাতে বিশাল সাদা চকচোকে ছুরি ও পরনে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী রক্তে ভেজা রয়েছে পাঞ্জাবীর হাতা।

ছোট ছোট বাচ্চারা তাদের কোমলমতি হাতে গো রক্ত মেখে এক পৈচাশিক আনন্দে মত্ত মহিলারা জানালা দিয়ে মুঠোফোনে কোরবানির দৃশ্যের ছবি ও ভিডিও ধারণ করছে। পরিবেশটা দেখে এখানে ঠিক ধর্মটা কোথায় আমার বোধগম্য হলনা। তাহলে কি বিশ্বে ২৩ শতাংশ মুসলিম ভুল পথে এবাদত করছে?
 
প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আরো একটু বিস্তারিত আলোচনা দরকার।

আজহা শব্দটির বাংলা অর্থ ত্যাগ বা উৎসর্গ আর কোরবান অর্থ নৈকট্য, সান্নিধ্য। উল্লিখিত শব্দ এবং অর্থগুলো থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, ত্যাগ বা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের যে চেষ্টা করা হয় তাকেই ঈদুল আজহা বা কোরবানি বলা হয়। কোরবানির হলো আল্লাহ'র সন্তুষ্টি অর্জনের অনন্য মাধ্যম। আদি পিতা আদম  এর যুগ থেকেই কোরবানির বিধান চালু হয়েছিল বলে বিশ্বাস। আদম  এর দুই ছেলে হাবীল ও কাবীল দু’জনেই কোরবানি দিয়েছিলেন। তাদের একজনের কোরবানি আল্লাহর কাছে কবুল হয়েছে এবং অন্যজনের কোরবানি কবুল হয়নি। পৃথিবীতে কোরবানির ইতিহাস এখান থেকেই শুরু।

কোরআনে এসেছে- আদম এর দু’পুত্রের একজনের কোরবানি কবুল হওয়ার পর কাবিল (যার কোরবানি কবুল হয়নি) বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন হাবিল (যার কোরবানি কবুল হয়) বলল, অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিদের কুরবানি কবুল করেন। যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হস্ত প্রসারিত কর, তবুও আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার প্রতি হস্ত প্রসারিত করব না। কেননা আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ২৭-২৮)

কোরবানির পিছনে আরো একটি ঘটনা রয়েছে। কিভাবে পশু বা গরুকে কোরবানির প্রথা চালু হল।



আজকের মুসলিম সমাজে যে কোরবানির প্রচলন রয়েছে তা মূলত  হযরত ইব্রাহীম এর দেখানো পথ থেকেই। হযরত ইব্রাহীম এর শতবর্ষ বয়সের পর আল্লাহ তাঁকে যে সন্তান দান করেছিলেন, সেই কলিজার টুকরা হযরত ইসমাইল কে আল্লাহ  কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে কোরবানির সূত্র ধরে আজও সেই কোরবানি প্রচলিত আছে।

একদিন হজরত ইবরাহিম পুত্র ইসমাইলকে বললেন, ‘হে ছেলে! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে জবেহ করছি। এ বিষয়ে তোমার অভিমত কি? সে (ইসমাইল) বলল, ‘পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা পালন করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০২) 

এর পরেই আল্লাহ বলেন, ‘মনে রেখো, এ ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে সুযোগ দিলাম এক মহান কোরবানির। পুরো বিষয়টি স্মরণীয় করে রাখলাম প্রজন্মের পর প্রজন্মে। ইব্রাহিমের প্রতি সালাম। এভাবেই আমি সৎকর্র্মশীলদের পুরস্কৃত করি।’ (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০৬-১১০)

আল্লাহ  ইবরাহীম এর পরীক্ষা নিয়েছেন ছেলেকে কোরবানীর আদেশ দিয়ে। যখন সেই পরীক্ষায় তিনি সফল হলেন, তখন আল্লাহ  সন্তুষ্ট হয়ে ইসমাইলের পরিবর্তে অন্য পশু জবেহ করে পুরস্কৃত করলেন ইবরাহীম কে। আর এইভাবেই প্রতিটি সৎ কর্মীশীলদের পুরস্কৃত করে থাকেন মহান আল্লাহ।
 
বিষয়গুলো আমাদের ভাববায়। ধর্মকে পরিবর্তনের  হিংসাত্মক কোন উদ্দেশ্য নেই তো?


আরো পড়ুন:

Comments

Populer Post

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের, প্রবন্ধে সেকালের বাবুচরিত্র

‘সাগুদানা’ একাদশীতে খাবেন? না খাবেন না?

রাজা শান্তনু, সত্যবতী এবং ঋষি পরাশরের অবস্থা মহাভারতের প্রকৃতি বদলে দিয়েছে ।

উপবীত বা পৈতার মাহাত্ম্য , উপবীত বা পৈতা কাহাকে বলে?

বৃন্দাবন ত্যাগ করে চিরতরে মথুরায় গমনকালে শ্রীকৃষ্ণের বয়স কত ছিল- শাস্ত্রীয় রেফারেন্স

বাড়িতে শ্রী গণেশ ঠাকুরের প্রতিস্থাপন এবং কীভাবে বির্সজন করবেন, জেনে নিন সহজ পদ্ধতি