জীবের খাদ্য এবং খাদ্যাভ্যাস

ঈশ্বরই সকল প্রাণীর জঠরে,
অবস্থান করে খাদ্য পরিপাক করেন।

যা খেয়ে প্রত্যেকটি জীব বেঁচে থাকে তাকেই অন্ন বলে।অন্নতেই সকল জীব বেঁচে থাকে। তাই মনুষ্যের স্থুল দেহকে অন্নময় কোষ বলা হয়।বর্তমানে অন্ন বলতে শুধু ভাতকেই বোঝানো হয়। কিন্তু বেদান্তে অন্ন বলতে চার প্রকার খাদ্যের কথা বলে হয়েছে। মনুষ্যসহ অধিকাংশ প্রাণীই মূলত এ চার প্রকারের খাদ্যই গ্রহণ করে। শ্রীমদভগবদগীতার পঞ্চদশ অধ্যায়ের চারপ্রকার অন্নের কথা বলা হয়েছে:

অহং বৈশ্বানরো ভূত্বা প্রাণিনাং দেহমাশ্রিতঃ।
প্রাণাপানসমাযুক্তঃ পচাম্যন্নং চতুর্বিধম্।।

"আমিই প্রাণিগণের উদরে বৈশ্বানর অগ্নিরূপে স্থিত হয়ে প্রাণ ও অপান বায়ুর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, এবং পেয় এ চতুর্বিধ অন্নকে পরিপাক করি।"

১.চর্ব্য- যা চিবিয়ে চিবিয়ে খাওয়া হয়; ভাত, রুটি সহ অধিকাংশ খাবার।
২.চোষ্য- যা চুষে চুষে খেতে হয়; শিশু এবং বৃদ্ধদের উপযোগী বিভিন্ন খাবার।
৩.লেহ্য- যা চেটে চেটে খেতে হয়; চাটনি জাতীয় বিভিন্ন খাবার।
৪.পেয়- যা পান করা হয়; দুধ, জল, চা ইত্যাদি।



ঈশ্বরই সকল প্রাণিগণের উদরে বা জঠরে বৈশ্বানর অগ্নিরূপে অবস্থান করেন। খাদ্য পরিপাককারী জঠরস্থ পাচকরসকে জঠরাগ্নি বা ইংরেজিতে (Gastric Juice) বলে। জঠরে বৈশ্বানর অগ্নিরূপে তিনি প্রাণ ও অপান বায়ুর সাথে সংযুক্ত হয়ে চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, এবং পেয় এ চতুর্বিধ অন্নকে পরিপাক করেন। অর্থাৎ প্রত্যেকটি জীব যত খাবার খায়, সে সকল খাবারই ঈশ্বর বৈশ্বানর অগ্নিরূপে পরিপাক করেন। তিনি যদি পরিপাক করে না করেন, তবে খাদ্য কখনো জীবনীশক্তিতে রূপান্তরিত হবে না। এ প্রসঙ্গে ঋগ্বেদ সংহিতার দশম মণ্ডলের 'দেবীসূক্ত' এর মধ্যে বলা হয়েছে, আদ্যাশক্তি মহামায়ার দ্বারাই সকল জীব আহার ভোজন করে; কারণ তিনিই ভোক্তৃশক্তিরূপা। তিনিই প্রত্যকটি জীবের শরীরে জঠরাগ্নি রূপে থেকে খাদ্য পরিপাক করে। জগতের প্রত্যেকটি জীব যে দর্শন করে, তা তাঁর শক্তিতেই দর্শন করে। প্রাণীকুলের সকল ইন্দ্রিয় পরিচালিত হয় দেবীর ইচ্ছায়। দেবীই প্রাণস্বরূপা হয়ে প্রত্যেকটি জীবের অভ্যন্তরে বিরাজিতা। তাই সকল জীব শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকে। জগতের সকল কর্মই দেবীর শক্তিতে সম্পন্ন হয়।প্রত্যেকটি জীব যে একে অন্যের কথা শ্রবণ করে, তা আদ্যাশক্তি মহামায়ার শক্তিতেই করে। তার শক্তিবিহীন সকলই নিস্পন্দিত নিথর। তিনিই অন্তর্যামিনীরূপে সর্বত্র বিরাজিতা।

ময়া সো অন্নমত্তি যো বিপশ্যতি
যঃ প্রাণিতি য ঈং শৃণোত্যুক্তম্ ।
অমন্তবো মাং ত উপক্ষিয়ন্তি
শ্ৰুধি শ্রুত শ্রদ্ধিবং তে বদামি ॥
(ঋগ্বেদ সংহিতা:১০.১২৫.৪)

"আমার দ্বারাই সকলে আহার ভোজন করে; কারণ আমি ভোক্তৃশক্তিরূপা। প্রত্যেকটি জীব যে দর্শন করে, আমারই শক্তিতেই করে; আমি দ্রষ্টৃশক্তিস্বরূপা। জীব যে যে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে প্রাণধারণ করে থাকে, তা আমার শক্তিতেই করে।প্রত্যেকটি জীব যে একে অন্যের কথা শ্রবণ করে, তা আমার শক্তিতেই করে। যারা আমাকে অন্তর্যামিনীরূপে জানে না, জ্ঞানরহিত ব্যক্তিরাই জন্মমরণাদি ক্লেশ প্রাপ্ত হয়ে সংসারে হীন হয়। হে কীর্তিমান! আমি তোমাকে পরম কল্যাণকর শ্রদ্ধালভ্য ব্রহ্মতত্ত্বের স্বরূপ বলছি, তা শ্রবণ কর।"

মানুষ্যের কাছে জীবন রক্ষার্থে অন্ন যেমন চাল, গম, ভুট্টা, বিবিধ প্রকারের সবজি, মাছ মাংস ইত্যাদি। তেমনি একটি বাঘ, সিংহের কাছে অন্ন হল ছাগ, হরিণ ইত্যাদি প্রাণীর মাংস। সকল প্রাণীর ভোজনকৃত সকল খাবারই উদরে বৈশ্বানর অগ্নিরূপে স্থিত হয়ে ঈশ্বর পরিপাক করে দেন। তবেই সেই খাবার খাদ্যশক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে শরীরকে পরিপুষ্ট করে। জগতে সকল বস্তুতে, সকল প্রাণীতে সর্বত্রই ব্রহ্ম বিরাজমান। প্রাণীর চতুর্বিধ খাদ্য থেকে খাদ্য শরীরের যে স্থানে পরিপাক হচ্ছে, তা সকলই ব্রহ্মময়। প্রানীর অন্নগ্রহণও একপ্রকার যজ্ঞ। শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বলা হয়েছে, যজ্ঞের স্রুবাদি যজ্ঞপাত্রও ব্রহ্ম; ঘৃতাদিসহ যজ্ঞের হবি ব্রহ্ম; যেখানে আহুতি দেয়া হচ্ছে, সেই অগ্নি ব্রহ্ম; যিনি হোমে আহুতি দিচ্ছেন তিনিও ব্রহ্ম; এইরূপ জ্ঞান যাঁর লাভ হয় সেই যোগীই ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন।

ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবিব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম্।
ব্ৰহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্ৰহ্মকর্মসমাধিনা৷৷
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা৪.২৪)

"অর্পণ (স্রুবাদি যজ্ঞপাত্র) ব্রহ্ম, ঘৃতাদি ব্রহ্ম, অগ্নি ব্রহ্ম, যিনি হোম করেন তিনিও ব্রহ্ম, এইরূপ জ্ঞানে ব্রহ্মরূপ কর্মে একাগ্রচিত্ত যোগী ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন"

বেদে বলে হয়েছে, "সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম"। জগতের সমস্ত কিছুই ব্রহ্ম। ব্রহ্ম বই আর কিছুই নেই। দেহের অভ্যন্তরে তীব্রতর অজ্ঞানের কারণে আমরা বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারি না। রামপ্রসাদ সেন বলেছেন, ব্রহ্মময়ী কালী সর্বঘটে অর্থাৎ সর্বত্রই বিরাজিতা। তাই আমরা যে আহার করি তা নিজের দেহকে নয়; তা যজ্ঞস্বরূপ আহুতি প্রদান করি শ্যামা মায়েরই উদ্দেশ্যে।

" ওরে মন বলি ভজ কালী, ইচ্ছা হয় যেই আচারে।
মুখে গুরুদত্ত মন্ত্র কর, দিবানিশি জপ করে।
শয়নে প্রণাম জ্ঞান, নিদ্রায় কর মাকে ধ্যান।
ওরে নগর ফির, মনে কর, প্রদক্ষিণ শ্যামা মারে।।
যত শোন কর্ণপটে, সকলি মায়ের মন্ত্র বটে।
কালীর পঞ্চাশৎ বর্ণময়ী, বর্ণে বর্ণে নাম ধরে।। কৌতুকে রামপ্রসাদ রটে, ব্রহ্মময়ী সর্বঘটে।
ওরে আহার কর, মনে কর, আহুতি দেই শ্যামা মারে।।"
( দ্বিতীয় চরণে 'মুখে' শব্দটির পাঠান্তর 'সদা' এবং পঞ্চম চরণে 'কর্ণপটে' শব্দটির পাঠান্তর 'কর্ণপথে'।)

তথ্য সহায়তা:
১. কল্পনা সেন, রামপ্রসাদ সেন ও সমকালীন ভারতবর্ষ, সুচেতনা, কলকাতা: প্রথম প্রকাশ ১৪১৮

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

Populer Post

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের, প্রবন্ধে সেকালের বাবুচরিত্র

‘সাগুদানা’ একাদশীতে খাবেন? না খাবেন না?

রাজা শান্তনু, সত্যবতী এবং ঋষি পরাশরের অবস্থা মহাভারতের প্রকৃতি বদলে দিয়েছে ।

উপবীত বা পৈতার মাহাত্ম্য , উপবীত বা পৈতা কাহাকে বলে?

বৃন্দাবন ত্যাগ করে চিরতরে মথুরায় গমনকালে শ্রীকৃষ্ণের বয়স কত ছিল- শাস্ত্রীয় রেফারেন্স

বাড়িতে শ্রী গণেশ ঠাকুরের প্রতিস্থাপন এবং কীভাবে বির্সজন করবেন, জেনে নিন সহজ পদ্ধতি