হিন্দুত্ববাদ ও মহাপ্রভুর অবদান
আজকাল ’হিন্দুত্ববাদ’ শব্দটির সাথে সকলে পরিচিত। কিন্তু এই হিন্দুত্ববাদী চেতনার জাগরণ আজ থেকে নয়। কালক্রমে বিভিন্ন যুগপুরুষের হাতে সাকার হয়েছে আজকের হিন্দুত্ববাদী চেতনা। মধ্যযুগে যে যুগপুরুষের হাত ধরে হিন্দুত্ববাদী নবজাগরণ তিনি শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু।
১৪০৭ শকাব্দে (১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে) যখন মহাপ্রভুর আবির্ভাব তখন ভারতবর্ষে কঠোর মুসলিম শাসন। দিল্লীতে তখন লোদী বংশের শাসন। ১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দে সিকান্দার লোদী দিল্লীর গদীতে বসেন এবং মথুরা ও অগ্রবন(বৃন্দাবনের অন্যতম বন) ধ্বংস করে আগ্রা স্থাপন করেন। বঙ্গদেশে তখন শাহ সুলতানদের শাসন চলছে। প্রকাশ্যে হরিধ্বনি, হরিনাম, পূজার্চন নিষিদ্ধ তখন। সুলতানের অনুচরদের কানে খবর গেলে গ্রামসহ উৎখাত করা হতো।
রাত্রিবেলায় হরিনাম করতেও জনসাধারণ ভয় পেত।
”নিশা হৈলে হরিনাম গায় উচ্চৈস্বরে।
এ ব্রাহ্মণ করিবেক গ্রামের উৎসাদ।।
মহা তীব্র নরপতি যবন ইহার।
এ আখ্যান শুনিলে প্রমাদ নদীয়ার।।
অন্যথা যবনে গ্রাম করিবে কবল।।- (শ্রীচৈ.ভা. আদি)
হিন্দুজাতির এরূপ সঙ্কটময় কালে মহাপ্রভুর জন্মলগ্নে চন্দ্রগ্রহণের ছলে সমগ্র ভারতবাসী হরিবোল হরিধ্বনি করে ওঠে। এমনকি মুসলিমগণও হিন্দুদের পরিহাস ছলে হরি হরি বলে।
‘হরি’ বলি হিন্দুকে হাস্য করয়ে যবন।”-(শ্রীচৈ.চ. আদি)
অবতীর্ণ হয়েই মহাপ্রভু জগৎবাসীকে হরিনামের শক্তির পরিচয় দেন।
জাতি-কূল-বর্ণ নির্বিচারে হরিনামসংকীর্তনের দ্বারাই অসংগঠিত হিন্দুজাতিকে সংগঠিত করার প্রথম পদক্ষেপ নেন মহাপ্রভু। তাঁর সংকীর্তন প্রভাবে তৎকালীন নবাবের প্রতিনিধি চাঁদকাজী বাঁধা দেয় এবং হিন্দুদের গণহারে মারতে শুরু করে।
”যাহারে পাইল কাজী, মারিল তাহারে।
ভাঙ্গিল মৃদঙ্গ, অনাচার কৈল দ্বারে।।”-(শ্রীচৈ.ভা. মধ্য)
সংকীর্তনে নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মহাপ্রভু এক বিশাল প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করেন যা ইতিহাসের প্রথম রাষ্ট্রদ্রোহী গণঅভ্যুত্থান(World’s first civil disobedience movement-Wikipedia) নামে পরিচিত।
মশাল হাতে অর্বুদ লক্ষ লোক সেদিন সংগঠিত হিন্দুত্ববাদের গুরুত্ব অনুভব করেছিল। অত্যাচারী শাসকের ঘাড় চেপে অধিকার আদায় করা শিখেছিল। সংকীর্তনে বাঁধাদানকারীর প্রতি মহাপ্রভুর পদক্ষেপ ছিল আপোসহীন।
”দেখো, আজি পোড়াও কাজীর ঘর-দ্বার।
কোন কর্ম্ম করে দেখো রাজা বা তাহার?”-(শ্রীচৈ.ভা. মধ্য)
এ মহাপ্রভু কেবল প্রেমের অবতার নন। উগ্র নরসিংহ আবেশও তাঁর মধ্যে বিদ্যমান। কাজীর দুয়ারে গিয়ে হুঙ্কার দেন কাজীকে ধরে এনে মাথা কেটে ফেলার। পরবর্তীতে যে আদেশ দেন তা আজকের উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের চেতনায় পর্যবেসিত।
”নির্যবন করোঁ আজি সকল ভুবন।”-(শ্রীচৈ.ভা. মধ্য)
সরাসরি এমন কঠোর বাক্য অন্য কোনো যুগপুরুষ বলেননি। মেকি ধর্মসমন্বয়ের নামে দুর্বলতা প্রদর্শন করেননি। হিন্দুবিরোধী, আক্রমণকারীদের প্রতি ডাইরেক্ট এ্যাকশন মহাপ্রভুর আপোষহীন অনন্য চরিত্র। মহাপ্রভুর নির্দেশে লোকসকল কাজীর বাড়ি ভাঙচুর করে এবং আগুন দিতে উদ্যত হয়।
”প্রভু বলে- অগ্নি দেহ বাড়ির ভিতরে।
পুড়িয়া মরুক সব গণের সহিতে।।”-(শ্রীচৈ.ভা. মধ্য)
মহাপ্রভুর প্রবল প্রতিরোধের সামনে কাজী পরাজয় স্বীকার করে এবং তার বংশের কেউ সংকীর্তনে বাঁধা দেবে না এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
”কাজী কহে মোর বংশে যত উপজিবে।
তাহাকে তালাক দিবো- কীর্তন না বাধিবে।।”-(শ্রীচৈ.চ. আদি)
মহাপ্রভুর হিন্দুত্ববাদী আদর্শের আরেকটি দিক হলো বিধর্মী শাস্ত্রগ্রন্থের সাথে শাশ্বত সনাতন ধর্মগ্রন্থকে এক কাতারে ফেলে কলুষিত করেননি। অধুনা অনেক সমাজসংস্কারক/ধর্মসংস্কারকগণ “সব ধর্মই শান্তির, সব ধর্মগ্রন্থই শান্তির কথা বলে”- টাইপের তোষামদি বাক্য প্রয়োগ করলেও মহাপ্রভুর হিন্দুত্ববাদী আদর্শে তোষামদের স্থান ছিলনা।
”তোমার শাস্ত্রকর্তা- সেহো ভ্রান্ত হৈল।
না জানি শাস্ত্রের মর্ম ঐছে আজ্ঞা দিল।।”-(শ্রীচৈ.চ. আদি)
উড়িষ্যায় পাঠান পীরকে তার শাস্ত্রের ভ্রান্তি দেখিয়ে হিন্দু ধর্মে প্রত্যাবর্তন করান এবং তার নাম দেন ’রামদাস’ । আরেক পাঠান রাজকুমার ও তার অনুচরদেরও হিন্দুধর্মে প্রত্যাবর্তন করান।
”তারই শাস্ত্র যুক্ত্যে প্রভু করিল খণ্ডন।।
প্রভু কহে তোমার শাস্ত্রে স্থাপি নির্বিশেষ।
তাহা খণ্ডি সবিশেষ স্থাপিয়াছে শেষ।।
তোমার পণ্ডিত সভের নাহি শাস্ত্রজ্ঞান।
’রামদাস’ বলি প্রভু নাম কৈল তার।
আর এক পাঠান তার নাম বিজুলী খান।
অল্প বয়স তাহার রাজার কুমার।
কৃষ্ণ বলি পড়ে সেই মহাপ্রভুর পায়।
সেই ত পাঠান সব বৈরাগী হইলা।।
’পাঠান বৈষ্ণব’ বলি হৈল তার খ্যাতি।–(শ্রীচৈ.চ. আদি)
এছাড়া বহু বৌদ্ধ ম্লেচ্ছ যবনাদি বিধর্মীদের হিন্দুকরণ করেন মহাপ্রভু এবং কৃষ্ণনাম দিয়ে তাদের উদ্ধারের পথ দেখান। বিধর্মীদের ধ্বংসকৃত বহু তীর্থস্থান পুনরুদ্ধার করেন। বর্ণপ্রথার অপপ্রয়োগ এবং জাতিভেদের আড়ালে নিপীড়ন রোধ করেন, আচণ্ডালে হরিনাম কীর্তন শিক্ষা দিয়ে তাদের হিন্দুত্বও রক্ষা করেন একই সাথে ভক্তিধর্ম যাজন দ্বারা মানবজীবনের চরম কল্যানের উপায় নিশ্চিত করেন।
সুতরাং আমরা যারা সনাতন ধর্মের অনুসারি তাদের উচিত হৃদয়ে হিন্দুত্ববাদী চেতনাকে লালন করা। একজন হিন্দুত্ববাদীর দ্বারা জগতেরে কতোটা কল্যাণ হয় তার জলন্ত উদাহরণ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূ।
লেখক,
অদিতি ব্যার্নাজী
বেনারস, ভারত
আরো পড়ুন:
Comments
Post a Comment