ভগবান শঙ্করাচাৰ্য্য (সংক্ষিপ্ত জীবনী)
জন্মদিবস ও শৈশব জীবনী
অদ্ভুত মেধা ও প্রতিভাসম্পন্ন ভগবান শঙ্করাচার্য্য ৭৮৮ (মতান্তর) খ্রিস্টাব্দে পুণ্যা বৈশাখী শুকা পঞ্চমী তিথিতে শিবের বরে অবতাররূপে আবির্ভূত হন। জন্মস্থান-ভারতের দক্ষিণ এ কেরল রাজ্যে উচ্চ নাম্বদ্রি ব্রাহ্মণ বংশে কালাডি গ্রামে। পিতা দ্বিজশ্রেষ্ঠ শিবগুরু, মাতা দেবীরূপিণী বিশিষ্টা দেবা।
পঞ্চম বৎসর বয়সে উপনয়ন গ্রহণান্তে গুরুগৃহে গমন করেন এবং মাত্র দুই বৎসরের মধ্যে সমস্ত শাস্ত্রপাঠ সমাপন করে সপ্তম বৎসর বয়সে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি ছিলেন শ্রুতিধর মহাপুরুষ। যখনই যাহা পড়িতেন বা শুনিতেন, সমস্তই তাঁর স্মৃতিপটে তখনই অঙ্কিত হয়ে যেত।
কিছুদিনের মধ্যেই বাড়িতে এক চতুষ্পাঠী খুলে বসলেন শঙ্কর। সকলে আশ্চর্য হয়ে গেল। স্থানীয় পণ্ডিতেরা তাচ্ছিল্যভাবে বলাবলি করতে লাগলেন, অনভিজ্ঞ বালক, শাস্ত্রের কি জানে? কি সে পড়াবে? তারা প্রথম প্রথম আমল দিতে চাইলেন না। কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারলেন না শাস্ত্রজ্ঞান, স্মৃতিশক্তি, বুদ্ধিমত্তা ও তর্কপ্রতিভার অধিকার শঙ্করের জন্মগত। ক্রমে এই সব কিছুর পরিচয় পেয়ে তাঁরা বাধ্য হলেন বালক শঙ্করের কাছে মাথা নত করতে। শঙ্করের চতুষ্পাঠীতে ছাত্রসংখ্যা বেড়ে যেতে লাগল দিনে দিনে। তাঁর অধ্যাপনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে লাগল দিনে দিনে। শঙ্করের মাতৃভক্তি ছিল গভীর। প্রতিদিন অধ্যাপনা ও পূজা-অর্চনার অবশিষ্ট সময়টুকু মায়ের সেবা করে কাটাতেন তিনি।
সন্ন্যাস
মাত্র আট বৎসর বয়সে কৌশলে মাতার অনুমতি লইয়া তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। প্রথমে তাঁর মা তাকে অনুমতি দিতে চাইছিলেন না। শেষে তিনি খুব আশ্চর্যজনকভাবে মায়ের অনুমতি পান। কথিত আছে, একদিন তিনি পূর্ণা নদীতে স্নান করছিলেন। এমন সময় একটি কুমির তাঁর পা কামড়ে ধরে। শঙ্করাচার্য্যের মাও সেই সময় পূর্ণার তীরে উপস্থিত ছিলেন। তিনি মা-কে বলেন, মা যদি সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দেন, তাহলে কুমিরটি তার পা ছেড়ে দেবে। ছেলের প্রাণ বাঁচাতে মা তাকে সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দিলেন। তার পর থেকে কোনোদিন পূর্ণা নদীতে কোনো কুমিরকে দেখা যায়নি।
পরে নর্মদাতীরস্থ ওঁকারনাথ গমন করে সেখানে মহাযোগী শ্রীমৎ গোবিন্দপাদের (মহর্ষি পতঞ্জলির) নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন। কঠোর সাধনা দ্বারা মাত্র ১২ বৎসর বয়সে সিদ্ধিলাভ করেন। তারপরে শ্রীগুরুদেবের নির্দেশে কাশীধামে গমন করেন। তখন হইতে শেষদিন পর্যন্ত (৩২ বৎসর) তিনি সনাতন ধর্মের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য আসমুদ্র হিমাচল পদব্রজে পরিভ্রমণ করেন।
দার্শনিক ভ্রমণ
ভারতবর্ষের চারি প্রান্তে চারিটি মঠ স্থাপন করে তিনি সনাতন হিন্দুধর্মকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। উত্তরে বদরিকাশ্রমে জ্যোতিৰ্ম্মঠ, দক্ষিণে রামেশ্বরমে শৃঙ্গেরী মঠ, পশ্চিমে দ্বারকায় শারদা মঠ এবং পূর্বে পুরীধামে গোবর্দ্ধন মঠ স্থাপন করে সমগ্র ভারবর্ষকে এই চারিটি মঠের অন্তর্ভুক্ত করেন। তাছাড়া সমগ্র সন্ন্যাসী সমাজকে সুসংগঠিত করে দশটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেন। তাঁহাদিগকে দশনামী (সন্ন্যাসী) সম্প্রদায় বলা হয়। শাস্ত্রীয় তর্কের মাধ্যমে সমস্ত বিরূদ্ধবাদীকে পরাস্ত করিয়া সমগ্র ভারতবর্ষে বিশুদ্ধ বৈদান্তিক ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি বহু শাস্ত্রীয় গ্রন্থ এবং ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য ইত্যাদি রচনা করেন। শঙ্করাচার্য্যের বেদান্তভাষ্য জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ বলিয়া পরিগণিত। শ্রীমদ্ভগবদগীতা, একাদশ শ্রেষ্ঠ উপনিষদ এবং ব্রহ্মসূত্র—এই প্রস্থানত্রয়ের উপর তাঁহার ভাষ্য জগদ্বিখ্যাত।
তাঁর প্রধান চারিজন শিষ্য—পদ্মপাদাচাৰ্য্য, হস্তামলকাচাৰ্য্য, সরেশ্বরাচাৰ্য্য (মণ্ডন মিশ্র) ও তোটকাচাৰ্য্যকে চারিটি মঠের প্রধান আচার্যরূপে প্রতিষ্ঠা করেন। আদি শঙ্কর অদ্বৈত দর্শনের বিরোধিতা করা সকল দর্শন অস্বীকারের দ্বারা এর প্রচারের জন্য দিগ্বিজয় ভ্রমণ শুরু করেন। তিনি দক্ষিণ ভারত হতে কাশ্মীর অভিমুখে ভারতের সর্বত্র এবং নেপাল ভ্রমণ করেন এবং পথিমধ্যে সাধারণ মানুষের মাঝে দর্শন প্রচার করেন এবং হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য পণ্ডিত ও সন্ন্যাসীদের সাথে দর্শন বিষয়ে তর্ক করেন।
মালয়ালী রাজা সুধনভকে সঙ্গী হিসেবে নিয়ে শঙ্কর তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং বিদর্ভের মধ্য দিয়ে যান। এরপর তিনি কর্ণাটকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন যেখানে তিনি একদল সশস্ত্র কাপালিকের সামনে পড়েন। রাজা সুদনভ তার সঙ্গীদের নিয়ে প্রতিরোধ করেন এবং কাপালিকাদের পরাজিত করেন। তারা নিরাপদে গোকর্ণে পৌঁছান যেখানে শঙ্কর বিতর্কে শৈব পণ্ডিত নীলাকান্তকে পরাজিত করেন।
আদি শঙ্করাচার্য অদ্বৈতবাদী ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন । তিনি বলেন যে , ব্রহ্মই হল একমাত্র সত্য - এই জগৎ ব্রহ্মময় । তাঁর মতে , " সঠিক বিদ্যা না থাকার ফলে মানুষ ব্রহ্মকে বুঝতে পারে না '' । আত্মাই হল ব্রহ্ম । এই ব্রহ্ম নির্গুণ এবং আনন্দময় । কিন্তু ব্রহ্ম আবার পারমার্থিক দৃষ্টিতে ব্রহ্ম হলেও ব্যবহারিক দৃষ্টিতে ঈশ্বর বলে প্রতিভাত হয় । অবিদ্যা ব্রহ্মের শক্তিবিশেষ যার ফলে জীব নিজেকে ব্রহ্মের থেকে ভিন্ন মনে করে । প্রকৃতপক্ষে , জীবাত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন।
মৃত্যু
শঙ্করাচার্যকে নিয়ে বহু চলচ্চিত্র তৈরী হয়েছে এবং তা বহু ভাষায়। মাত্র বত্রিশ বৎসর বয়সের মধ্যে সমগ্র ভারতবর্ষে সনাতন ধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত করে ৮২০ খ্রীষ্টাব্দে সেচ্ছায় কেদারনাথধামে এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন।
আরো পড়ুন: স্বামী শ্রীপ্রণবানন্দ মহারাজ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী ও ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ
আরতি তত্ত্ব বা আরতি-মাহাত্ম্য ও আরতির শাস্ত্রীয় বিধি
ভাইভোঁটার শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা ও উৎপত্তি ইতিহাস
Comments
Post a Comment