আরতি তত্ত্ব বা আরতি-মাহাত্ম্য ও আরতির শাস্ত্রীয় বিধি

 আরতি

আরতি = আরাত্রিক = নীরাজন আরতিকে আরাত্রিক বা নীরাজন বলে

আরম্ + ক্তি ভাববাচ্যে = আরতিঅর্থে ব্যাপ্তি; “রতিঅর্থে প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা অনুরাগ সুতরাং যে অনুষ্ঠান বা প্রকরণের দ্বারা ইষ্টের বা শ্রীভগবানের  নিজের প্রীতি বৰ্ধিত হয় অর্থাৎ তিনি সাধকের প্রতি প্রসন্ন বা সন্তুষ্ট হন এবং ইষ্টের প্রতিও সাধকের প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা অনুরাগ বৃদ্ধি পায়, তাহাকে আরতি বলে সুতরাং আরতি কখনও শুষ্ক অনুষ্ঠান নয় ইহা অন্তরের গভীর ভাবের জিনিস

অতএব আন্তরিক ভাবভক্তি, আকুলতা-ব্যাকুলতা লইয়া প্রত্যহ পূজারতি করতে হয়আজকাল হিন্দু ধর্মের অবক্ষয়গুলোর মধ্যে একটি হল পূজার সময় আরতিতে অনীহা এবং উচ্চস্বরে ডিজে গান বাজানো।

 এবার আসুন, আরতি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক। শ্রীশ্রীঠাকুর স্বমুখে বলেছেন—“দৈনন্দিন পূজারতির ভিতর দিয়েই আমার শক্তি সকলের মধ্যে সঞ্চারিত হয় গুরুশক্তি লাভের এটা একটি সহজ শ্রেষ্ঠ উপায়

আজ আমি আরতি সম্পর্কে শাস্ত্রানুসারে আলোচনা করব। তাই ধৈর্য্য ধরে মনোযোগ সহকারে পড়লে এই বিষয়ে অনেক অজানা তথ্য পেতে পারেন।

আরতির উদ্দেশ্য

শাস্ত্রীয় পূজার বিধান অতি জটিল কিন্তু আরতির অনুষ্ঠান খুবই সহজসাধ্য যিনি শাস্ত্রীয় পূজার বিধি মন্ত্র না জানেন, তিনি আরতির মধ্য দিয়াই সকল পূজার ফল লাভ করতে পারেন বস্তুতঃ আরতিই সকল পূজার সার শাস্ত্রীয় পূজাও যদি বিধিহীন মন্ত্রহীন হয়, তবে আরতির মধ্য দিয়েই তা সম্পূর্ণতা লাভ করে স্বয়ং দেবাদিদেব শিব দেবী পার্বতীকে এই কথাই বলিয়াছেন, যথা:

মন্ত্রহীনং ক্রিয়াহীনং যকৃতং পূজনং হরেঃ।। 

সৰ্ব্বং সম্পূর্ণতামেতি কৃতে নীরাজনে শিবে।।

হে দেবি পাৰ্বতি, শ্রীভগবানের পূজা যদি মন্ত্রহীন ক্রিয়াহীন হয়, সে সমস্তই নীরাজন বা আরতির দ্বারা সম্পূর্ণতা লাভ করে (নীরাজন অর্থ দীপাবর্তন বা আরতি)

আরতির সাধারণ উপচার

() ধূপ বা ধূপতি, () পঞ্চপ্রদীপ, () জলশঙ্খ, () ত্রিশূল, () চামর, () পাখা () পুষ্প

সাধারণত এই ৭টি উপচার বা জিনিষ দ্বারা শ্রীশ্রীঠাকুরের দৈনন্দিন পূজারতি করা হয়

ইহা ছাড়া বিশেষ বিশেষ শুভদিনে বা উৎসবাদিতে আরও কয়েকটি বেশী উপচার দিয়া আরতি করা হয় যথা— () কৰ্পর () ঝাড়প্রদীপ, () মোমবাতি, (৪)তরবারি, (৫)সুদর্শন চক্র, (৬)খড়গ,(৭)বস্ত্র ও,(৮)পঞ্চফল ইত্যাদি ।



আরতি-মাহাত্ম্য

এসব উপাচরে আরতি করার বিশেষ অর্থ কি পূর্বেই উক্ত হয়েছে—  আরতির অর্থশ্ৰীভগবানের প্রতি প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা অনুরাগ বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের বিষয়ের প্রতি আছে তীব্র আসক্তি বা তার সেই আসক্তি ত্যাগ না হলে শ্রীভগবানের প্রতি আন্তরিক প্রাণের টান বা অনুরাগ বৃদ্ধি পায়না সেই বিষয়াসক্তি ত্যাগের সমস্ত উপচারে আরতি করা হয়ে থাকে কিরূপে সেই ত্যাগ হয় সেই কথাই বলা হবে।

শাস্ত্র বলা হয়েছেএই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে পঞ্চ মহাভূত হতে সেই পঞ্চ মহাভূত তাদের পঞ্চবিষয় এবং যে পঞ্চেন্দিয় দ্বারা জীব বিষয় ভোগ করে। সেগুলো হল

পঞ্চ মহাভূত: ক্ষিতি বা পৃথিবী, ২ অপ বা জল, ৩ তেজ বা অগ্নি, ৪ মরুৎ বা বায়ু ও ৫ব্যোম বা আকাশ শব্দ

 পঞ্চ বিষয়:গন্ধ, ২ রস, ৩রূপ, ৪ স্পর্শ  শব্দ

 পঞ্চ ইন্দ্রিয়: চক্ষু, কর্ণ, ৩ নাসিকা, জিহ্বা, ও ৫ ত্বক

 

 

এই পঞ্চ উপচার দিয়া আরতি করলে উক্ত বিষয়ের তীব্র আসক্তি দূর হয় (আরতির সময় শ্রীভগবচ্চরণে উক্ত বিষয়গুলি  মনে মনে নিবেদন করতে হয়  তাহলে তাদের প্রতি আসক্তিদূর হয়

এই পঞ্চ বিষয়ের বা মহাভুতের প্রতীক হচ্ছে-

ধূপ - ক্ষিতি বা গন্ধের প্রতীক

পঞ্চপ্রদীপ- তেজ বা রূপের প্রতীক

  জলশঙ্খ-- অপ বা রসের প্রতীক

পাখা-চামর - মরুৎ (বায়ু) বা স্পর্শের প্রতীক

  বাদ্য স্তব পাঠ - ব্যোম (আকাশ) বা শব্দের প্রতীক

আর () ত্রিশূল, তরবারি, চক্র ইত্যাদি হচ্ছে ভিতরের শত্রু অর্থাৎ রিপু-ইন্দ্রিয়, মায়া-মোহ, অহঙ্কার-অভিমান প্রভৃতি হতে আত্মরক্ষার প্রতীক

() পুষ্প হচ্ছেভক্তি বা আত্মনিবেদনের প্রতীক (হে আমার প্রাণের ঠাকুর, আমার এই জীবন-কুসুমটিও তোমারই রাতুল শ্রীপাদপদ্মে অর্ঘ্যরূপে উৎসর্গ বা নিবেদন করলাম তুমি কৃপাপূর্বক গ্রহণ করে এই দীনসন্তানকে ধন্য কর)

এইভাবে এই সমস্ত উপচারে আরতির মাধ্যমে শব্দ-স্পর্শরূপ-রস-গন্ধএই পঞ্চ বিষয়ের প্রতি ইন্দ্রিয়গুলির আসক্তি দূর করে শ্রীভগবান শ্রীগুরুচরণে আত্মনিবেদন করতে হয় তখনই তাঁর প্রতি যথার্থ প্রেম-প্রীতি, অনুরাগ-ভালবাসা জাগ্রত হয়ে সাধক জন্ম-জন্মান্তরীন বন্ধন হতে মুক্ত হয় তখন সাধক মহামুক্তি বা পরাশান্তি লাভে ধন্য কৃতকৃতার্থ হয় এছাড়া, পঞ্চ মহাভূত হতেই যেহেতু জগতের সমস্ত কিছু উৎপন্ন হয়েছে, সেইহেতু এই সমস্ত উপচার দ্বারা আরতি করিলে সমস্ত কিছুই শ্রীভগবানে নিবেদন করা হয়

সংক্ষেপে এটা হল আরতি তত্ত্ব বা আরতি-মাহাত্ম্য



আরতির শাস্ত্রীয় বিধি নিম্নরূপ

আদৌ চতুষ্পদ-তলৈক দেশে,দ্বৌ নাভিদেশে মুখমণ্ডলে ত্রীন

 সৰ্ব্বেষু গাত্রেষু সপ্তবারান্, আরাত্রিকং তন্মুনয়ো বদন্তি।।

 অর্থাৎ আররি প্রত্যেক দ্রব্য দেবতার পদতলে চারিবার, নাভিদেশে দুইবার, মুখমণ্ডলে তিনবার এবং সর্বাঙ্গে সাতবার ঘুরাতে হয় আরতির সময় দেবতার শ্রীচরণ, নাভি, মুখমণ্ডল পূত অঙ্গে দৃষ্টিপাত করে আরতি করতে হয় অন্য কোনদিকে তাকাতে নাই তখন মনে মনে অনুক্ষণ প্রার্থনা করতে হয়

 কিন্তু ভগবান আচাৰ্য্যদেব বলতেনআরতি আবার কি? আরতি হল আড়াই প্যাচ। অর্থাৎ অহেতুক ভাবভক্তিহীন দীর্ঘক্ষণ ধরে আরতি তিনি পছন্দ করতেন না সাধারণতঃ দৈনন্দিন পূজারতি ১৫/২০ মিনিটের মধ্যেই শেষ করতে হয়


আরো পড়ুন:  কলিযুগে সংঘ শক্তি

                    ভগবান শঙ্করাচাৰ্য্য (সংক্ষিপ্ত জীবনী)  

                     গঙ্গা স্নানের মাহাত্ম্য ও তার ফলাফল, কবে কোন স্নান করা উচিত, শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা

                    নমস্কার কেন করা হয়?


Comments

Populer Post

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের, প্রবন্ধে সেকালের বাবুচরিত্র

‘সাগুদানা’ একাদশীতে খাবেন? না খাবেন না?

রাজা শান্তনু, সত্যবতী এবং ঋষি পরাশরের অবস্থা মহাভারতের প্রকৃতি বদলে দিয়েছে ।

উপবীত বা পৈতার মাহাত্ম্য , উপবীত বা পৈতা কাহাকে বলে?

বৃন্দাবন ত্যাগ করে চিরতরে মথুরায় গমনকালে শ্রীকৃষ্ণের বয়স কত ছিল- শাস্ত্রীয় রেফারেন্স

বাড়িতে শ্রী গণেশ ঠাকুরের প্রতিস্থাপন এবং কীভাবে বির্সজন করবেন, জেনে নিন সহজ পদ্ধতি