স্বামী শ্রীপ্রণবানন্দ মহারাজ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী ও ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ


     ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ একটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ও অসাম্প্রদায়িক ধর্মীয় সেবা প্রতিষ্ঠান। সনাতন ধর্মের ভিত্তিতে জাতিগঠন এর মুখ্য উদ্দেশ্য। আর জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আৰ্ত্ত, পীড়িত, দুঃস্থ মানুষের সর্বপ্রকার নিঃস্বার্থ সেবাই—এই সঙ্ঘের প্রধান কাজ। গত ২০০ বছরে ভারতীয় উপমহাদেশে অসংখ্য ভন্ড ভগবানের জন্ম হয়েছে। যারা নিজেদেরকে অবতর বলে ঘোষণাও দিয়েছেন। অথচ তারা সমগ্র জীবনে নিজেদের পুটলা গোছাতেই ব্যস্ত ছিল। জাতি তাদের কাছ থেকে বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কিছুই পাইনি।

   এই সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা—অলৌকিক মহাতপঃ শক্তিশালী যুগাচাৰ্য্য শ্রীশ্রীমৎ স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজ। ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দের ২৯শে জানুয়ারী কলিযুগাদ্যা পুণ্যময়ী মাঘীপূর্ণিমা তিথিতে সাক্ষাৎ শিবের বরে শিবাবতাররূপে এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের শুভ আবির্ভাব। জন্মস্থান—বর্তমান বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার বাজিতপুর গ্রাম। পিতা—শ্রীবিষ্ণুচরণ ভুইয়া, মাতা—শ্ৰীমতী সারদাদেবী। আজন্ম কঠোর তপস্বী ব্রহ্মচারী বিনোদ (বাল্যনাম)  ১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দে গরোক্ষপুরে (উত্তর প্রদেশ) মহাযোগী বাবা গম্ভীরনাথজীর নিকট দীক্ষাগ্রহণ করে কঠোরতর সাধনায় নিমগ্ন হন এবং ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দের শ্রীশ্রী মাঘীপূর্ণিমায় বাজিতপুর সিদ্ধপীঠে মহাসিদ্ধি লাভ করেন। 


সিদ্ধিলাভের পর তাঁর শ্রীমুখের প্রথম মহাবাণী— 

এ যুগ মহাজাগরণের যুগ, এ যুগ মহাসমন্বয়ের যুগ, এ যুগ মহামিলনের যুগ, এ যুগ মহামুক্তির যুগ।


      ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দের শ্রীশ্রী মাঘীপূর্ণিমার শুভদিনে বাজিতপুর সিদ্ধপীঠে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন—এই বিখ্যাত ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ। ১৯২৪ খ্রীঃ-এ প্রয়াগধামে কুম্ভমেলায় শ্রীমৎ স্বামী গেবিন্দানন্দ গিরিজীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণপূর্বক তিনি আচার্য্য স্বামী প্রণবানন্দ’ নাম গ্রহণ করেন। তাঁহার তপঃশক্তির আকর্ষণে শুদ্ধ পবিত্ৰ-চরিত্র যুবকবৃন্দ তাঁর সন্নিকটে এসে “আত্মননা মাক্ষোর্থং জগদ্বিতীয় চ”—এই মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হইয়া সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। তাদেরকে নিয়েই এই মহাসঙ্ঘ গড়ে ওঠে।

        প্রথমে তিনি বালক ও যুবকদের নৈতিক চরিত্র গঠনের জন্য প্রবর্তন করেন—ব্রহ্মচর্য্য আন্দোলন। শত সহস্র ছাত্র, শিক্ষক ও যুবকগণ তাঁর পূত ভাগবত সংস্পর্শে এসে সংযম ও ব্রহ্মচর্য্য পালনপূৰ্ব্বক নৈতিক জীবন-গঠনে প্রবৃত্ত হয়। তাদেরকে সেবার আদর্শে গড়ে তোলার জন্য তিনি উৎসাহ দিয়ে বললেন—“যে শুধু নিজের সুখ-সুবিধা, আরাম-বিরাম নিয়ে থাকে, সে কি আর মানুষ! দেশের দুঃখ-দুর্দশায় যার প্রাণ কাঁদে না, জাতি ও সমাজের বিপদ-আপদে যে ব্যথা অনুভব করে না, সে তো নিতান্ত জড় পদার্থ;  গাছ-পাথরের সঙ্গে তার পার্থক্য কি? নিজের দুঃখকষ্ট দূর করার জন্য মানুষ যেরূপ প্রাণপাত করে, অপরের দুঃখকষ্টও তেমনিভাবে দূর করার জন্য যখন প্রাণপণ চেষ্টা করতে পারবে, তখনই প্রকৃতপক্ষে জাতির সেবা, সমাজের কল্যাণ সাধিত হবে।”—এইভাবে তিনি দেশের ভবিষ্যৎ আশা-ভরসা-স্বরূপ যুবকবৃন্দকে মহান দেশসেবার ব্রতে উদ্বুদ্ধ করছেন।


      ক্রমে তাঁর জাতিগঠন ও ধৰ্ম্মান্দোলনকে করেন বহুমখী । ধর্মপ্রচার, তীর্থসংস্কার, শিক্ষাবিস্তার, জনসেবা, হিন্দু মিলন-মন্দির ও রক্ষীদল গঠন, আদিবাসী ও অনুন্নতোন্নয়ন, অস্পশ্যতা নিবারণ, শুদ্ধি আন্দোলন, বর্হিভারতে ভারতীয় সংস্কৃতি প্রচার প্রভৃতি বিভিন্ন গঠনমূলক কৰ্ম্মে তিনি শত শত সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী ও কর্মীগণকে নিয়োগ করেন। ধর্মপ্রচারের জন্য ৮-১০টি প্রচার দল তৈরী করে সমগ্র  দেশে গ্রামে গ্রামে, শহরে শহরে ধৰ্ম্ম প্রচারের ব্যবস্থা করেন। গয়া, কাশী, পুরী, প্রয়াগ, বৃন্দাবন, হরিদ্বার প্রভৃতি তীর্থক্ষেত্রে অত্যাচারী পাণ্ডাদের দমনপূর্বক পুণ্যার্থী তীর্থযাত্রীদের নিরাপদ আশ্রয় ও স্বল্পব্যয়ে তীর্থকৃত্যের সুব্যবস্থা করেন। শিক্ষাবিস্তারের জন্য অবৈতনিক প্রাথমিক ও নৈশ বিদ্যালয়, আদর্শ ছাত্রাবাস প্রভৃতি স্থাপন করে প্রকৃত মানুষ গঠনের শিক্ষা দিয়ে গেছেন। বন্যায়-প্লাবনে, ঝড়ে-ঝায়, দুর্ভিক্ষে-ভূমিকম্পে অগ্নিকাণ্ডে, যুদ্ধে-বিপ্লবে এবং কুম্ভমেলা, গঙ্গাসাগর মেলা প্রভৃতি বিরাট বিরাট ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নির্বিশেষে যে কোন আত্ত, বিপন্ন নরনারীর সর্বপ্রকার সেবার ব্যবস্থা করেছেন। 

     ১৯৩৪ খৃঃ এ সঙ্ঘনেতা আচার্য্য বিশাল হিন্দুজাতিকে এক ধৰ্ম্মসূত্রে গেঁথে ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী হিন্দুজাতি গঠনপূরক ভারতের জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হন।সেজন্য তিনি সমগ্র দেশময় হিন্দু মিলন মন্দির ও রক্ষীদল গঠন” আন্দোলন আরম্ভ করেন। তিনি বলতেন, “মিলন হয় সমানে সমানে, সবলে সবলে, সবলে  দুর্বলে কখনও মিলন হয় না।”


     দেশের লক্ষ লক্ষ আদিবাসী ও অনুন্নত শ্রেণীর উন্নয়নের জন্য তিনি তার সন্তানদের ডাক দিয়ে বললেন—“এই পতিত জাতিকে উদ্ধারের জন্য তোমাদের সমগ্র শক্তি নিয়োগ করতে হবে। হীন-অন্ত্যজ জাতিকে কোলে তুলে নিতে হবে। তোমরা নিত্য-শুদ্ধ-মুক্ত-স্বভাব নিয়ে পরিত্রাণ কর— পতিতকে, রক্ষা কর¬— বিপন্নকে, আশ্রয় দাও—নিরাশ্রয়কে, শান্তি-সুখ দাও—সন্তপ্তকে।” বিদেশী ও বিধর্মীদের অত্যাচারে, প্রলোভনে এবং ছলে-বলেকৌশলে যে সমস্ত হিন্দু ভাই-বোন ধর্মান্তরিত হয়েছে, তাদেরকে আইনতঃ ও শাস্ত্ৰতঃ শুদ্ধি করে পুনরায় স্বধর্মে ফিরে আনার সুব্যবস্থা করেন।


     পরিশেষে, ভারতের সুমহান্ ধর্ম, সংস্কৃতি, আদর্শ ও ভাবধারা সমগ্র বিশ্বজগতে ছড়িয়ে দেবার জন্য তিনি তাঁর সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী সন্তানগণকে পৃথিবীর দিকে দিকে প্রেরণ করেন। একদিকে ব্রহ্মদেশ, রেঙ্গুন, সিঙ্গাপুর, মালয়, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যাণ্ড, কম্বোডিয়া প্রভৃতি এবং অপরদিকে আমেরিকা, ত্রিনিদাদ, লণ্ডন, নিউইয়র্ক, কানাডা, আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে সন্ন্যাসীগণ প্রচারব্রতে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েন।  এইভাবে মাত্র ৪৫ বৎসরের স্বল্পজীবনের মধ্যে সঙ্ঘনেতা ভগবান প্রণবান্দজী সমগ্র মানবের সামগ্রিক উন্নতিকল্পে বিরাট ধর্ম আন্দোলন ও শক্তি সঞ্চার করিয়া ১৯৪১ খৃঃ ৮ই জানুয়ারী  কলিকাতা বালিগঞ্জ আশ্রমে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণকারী সঙঘ-সন্ন্যাসীবৃন্দ তাঁর সুমহান কর্মধারা জগতের দিকে দিকে অবিরাম গতি ছড়িয়ে যাচ্ছে।



    তিনি মহা আশ্বাস দান করে বলেছেন—“কঠোর তপঃসাধনায় এই দেহকে আশ্রয় করে যে মহাশক্তির বিকাশ হয়েছে, তাহা সমগ্র মানবজাতিকে মহামুক্তিদানে সমর্থ। যাও, তোমরা জগতের ঘরে ঘরে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলকে এই মহাশক্তির সংস্পর্শে আনয়ন কর। এই সঙ্ঘকে সাধারণ মঠ বা আশ্রম বলে মনে করবে না— এটা ঐশী শক্তি সম্পন্ন। এর মধ্য দিয়েই জগতের মহাকল্যাণ সাধিত হবে।” 

     সুতরাং এই সঙ্ঘের আশ্রয় গ্রহণ করে সঙ্ঘনেতা প্রণবানন্দজীর আদর্শে আত্মসমর্পণ করলেই মানব অভীষ্ট পরমপদ ও পরম শান্তি প্রাপ্ত হবে।



আরো পড়ুন:     ভগবান শঙ্করাচাৰ্য্য (সংক্ষিপ্ত জীবনী) 

                      আরতি তত্ত্ব বা আরতি-মাহাত্ম্য ও আরতির শাস্ত্রীয় বিধি 

                      ভাইভোঁটার শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা ও উৎপত্তি ইতিহাস 

                      কলিযুগে সংঘ শক্তি 

                            



Comments

Populer Post

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের, প্রবন্ধে সেকালের বাবুচরিত্র

‘সাগুদানা’ একাদশীতে খাবেন? না খাবেন না?

রাজা শান্তনু, সত্যবতী এবং ঋষি পরাশরের অবস্থা মহাভারতের প্রকৃতি বদলে দিয়েছে ।

উপবীত বা পৈতার মাহাত্ম্য , উপবীত বা পৈতা কাহাকে বলে?

বৃন্দাবন ত্যাগ করে চিরতরে মথুরায় গমনকালে শ্রীকৃষ্ণের বয়স কত ছিল- শাস্ত্রীয় রেফারেন্স

বাড়িতে শ্রী গণেশ ঠাকুরের প্রতিস্থাপন এবং কীভাবে বির্সজন করবেন, জেনে নিন সহজ পদ্ধতি