বৃন্দাবন ত্যাগ করে চিরতরে মথুরায় গমনকালে শ্রীকৃষ্ণের বয়স কত ছিল- শাস্ত্রীয় রেফারেন্স


আজকাল আমরা ভারতীয় হাস্যকর, অবাস্তব, মনগড়া, কাল্পনিক কিছু সিরিয়াল দেখি। সেখানে আমরা দেখি রাধানাম্নী এক কাল্পনিক চরিত্রের সাথে যুবক বয়সী শ্রীকৃষ্ণের প্রেম কাহিনী । একদম যেন সিনেমার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রেমকাহিনীর মতো।

শ্রীকৃষ্ণের জীবনীগ্রন্থ হলো হরিবংশ । তাঁর জন্ম, বাল্যকাল থেকে শুরু করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সব হরিবংশে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে হরিবংশে উল্লেখিত আছে । যদিও এই হরিবংশের ৮০ শতাংশেরও বেশী পরবর্তীকালের লেখা প্রক্ষিপ্ত শ্লোক, এর কোন অংশেই রাধা নামের কারো নামধাম, অস্তিত্ব ই নেই । অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের জীবনীতে রাধা নামের কারও অস্তিত্ব নেই। একদম অনেক পরবর্তীকালে লেখা কিছু বৈষ্ণবীয় সাহিত্য ও পৌরাণিক রূপকথার গ্রন্থে এই কাল্পনিক চরিত্রের কথা পাওয়া যায় । 



বিশেষ করে বৈষ্ণবীয় সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুইটি গ্রন্থ বিষ্ণু পুরাণ ও ভাগবত পুরাণে রাধা নামক কারো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না । অভিনবগুপ্ত ও পর্যটক আল বিরুনীর পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা জানতে পারি ভাগবত পুরাণের বয়সকাল ৮ম শতক থেকে ১০ম শতকের দিকে অর্থাৎ মাত্র ১ হাজার থেকে ১২০০ বছর আগের। বিষ্ণুপুরাণের বর্তমান পাণ্ডুলিপিরও অধিকাংশ ই ৯ম শতক বা তার পরের দিকের বলে গবেষকদের মত । আর এই দুইটি গ্রন্থে রাধা নামের কারো উল্লেখ নেই । 

তবে বিষ্ণুপুরাণ ৫ম খণ্ডের ১৩ নং অধ্যায়ের ৩২-৩৮ নং শ্লোকে ও ভাগবত পুরাণ ১০ম স্কন্ধে প্রথমবারের মতো এক বিশেষ গোপীর কথা উল্লেখিত হয় কিন্তু তার নামধাম বা কোন প্রকার পরিচয় উল্লেখিত নেই সেখানে । এ থেকেই বুঝা যায় এই বিশেষ গোপীর উল্লেখ থেকেই খ্রিষ্টীয় ১০ম শতকের পর ধীরে বৈষ্ণব সাহিত্যসমূহে রাধার আবির্ভাব ঘটে। দ্বাদশ শতকে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, মধ্যযুগের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, গীতগোবিন্দ ইত্যাদির মাধ্যমে তা ব্যপক আকার ধারণ করে। অর্থাৎ এই চরিত্রটির আবির্ভাব মূলত ১ হাজার বছর আগে মাত্র  ।

অর্থাৎ আমরা দেখলাম রাধা নামক কোন চরিত্রের কথা শ্রীকৃষ্ণের জীবনী গ্রন্থ হরিবংশে নেই, বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দুইটি গ্রন্থ বিষ্ণু পুরাণ ও ভাগবত পুরাণেও নেই । মহাভারতে বিভিন্ন স্থানে ফ্ল্যাশব্যাক হিসেবে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যকালের কথা থাকলেও রাধা নামের কারো কোন কথা নেই । অথচ বর্তমানে এমনভাবে অনেকেই উপস্থাপন করেন যে শ্রীকৃষ্ণের জীবনের ৯০ ভাগ ই রাধা, অনেকেই বলেন রাধাই নাকি শ্রীকৃষ্ণের গুরু! শ্রীকৃষ্ণের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম শ্রীকৃষ্ণের জীবনী হরিবংশেও নেই, বিষ্ণুপুরাণ, ভাগবত পুরাণে নেই, মহাভারতেও নেই, ১ হাজার বছর আগের কোন বইতেই নেই, এরচেয়ে আশ্চর্য আর কী হতে পারে! এত গুরুত্বপূর্ণ হলে তো শ্রীকৃষ্ণের জীবনীতে অন্তত কয়েকশবার রাধার উল্লেখ থাকার কথা!



যাই হোক সেটা আমাদের আজকের আলোচ্য নয় । আমাদের আলোচ্য হলো এই যে টিভি সিরিয়ালগুলোতে বৃন্দাবনে যুবক শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার মনগড়া কাহিনী দেখানো হচ্ছে এগুলো সম্ভব ই না । কারণ যুবক বয়সে শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে ছিলেন ই না! পৌরাণিক যেসব গ্রন্থ আছে সেগুলোর অনুযায়ী ই সম্ভব না এই কাল্পনিক মনগড়া কাহিনী । আমরা পৌরাণিক সাহিত্য থেকেই তার প্রমাণ আজকে দেখব ।

হরিবংশে আমরা পাই বালক বয়সে শ্রীকৃষ্ণের কাছে কংসের নির্দেশে কংসের দূত অক্রুর আসেন । এসে তাঁকে আমন্ত্রণ জানান মথুরায় আগমনের । বলেন-

মাতাপিতৃভ্যম্ সর্বেণ জাতেন তনয়েন বৈ।
ঋণম্ বৈ প্রতিকর্তব্যম্ যথাযোগমুধৃতম্।।
(২.২৬.২৪)

তনয়ের জন্ম পিতা ও মাতা হতে হয়, তাদের প্রতি ঋণ যথাসম্ভব পরিশোধ করা কর্তব্য ।

অর্থাৎ পিতামাতা মথুরায় কংসের কাছে বন্দী । শ্রীকৃষ্ণের উচিত সেখানে গিয়ে পিতামাতাকে উদ্ধারের চেষ্টা করে ঋণশোধ করা ।

বৈষ্ণব সাহিত্যের অন্যতম ভাগবত পুরাণে পাই-

ততো নন্দব্রজমিতঃ পিত্রা কংসাদ্বিবিভ্যতা।
একাদশ সমাস্তত্র গুঢ়ার্চিঃ সবলোऽবসৎ।।
(ভাগবত পুরাণ ৩.২.২৬)

অর্থাৎ তার পিতা(বসুদেব) কংসের ভয়ে ভীত হয়ে তাকে নন্দের গৃহে পাঠিয়ে দিলেন, ১১ বছর বয়স পর্যন্ত  তিনি সেখানে বাস করলেন।

হরিবংশে আমরা দেখি সেইসময় বৃন্দাবনে অক্রুর এর আগমন ঘটে এবং তার সাথে কৃষ্ণ ও বলরাম উভয়েই চিরতরে বৃন্দাবন ত্যাগ করেন এবং মথুরায় গমন করেন, আর কখনো ফিরে আসেন নি । অর্থাৎ ১১ বছর বয়সের মাথায় তিনি বৃন্দাবন ত্যাগ করেন ।

হরিবংশ আমরা দেখি যাদবদের মধ্যে কংসের প্রধান প্রতিদ্বন্দী বসুদেবের পুত্র শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরায় আসছেন এই সংবাদ পেয়ে বিদ্রোহের আশংকায় কংস তার পার্ষদদের নিয়ে একটি আলোচনা সভা ডাকেন এবং সেখানে বলেন-

অবাল বাল্যমাস্থায় রমতে শিশুলীলয়া ।
(২.২২.৩১)

এই বালকটি ছোট শিশুর ন্যায় হলেও সে আসলে ছোট শিশু নয় (কৃষ্ণ ও বলরামের শক্তির গুরুত্ব অনুধাবন করে)।

অর্থাৎ স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি মথুরা ত্যাগকালে শ্রীকৃষ্ণ শিশুর ন্যায় বালক ছিলেন ।

ভাগবত পুরাণে আমরা দেখি মথুরায় আগমনের পর মথুরার লোকজন কৃষ্ণ ও বলরামের বর্ণনা দিচ্ছিলেন এভাবে-

ক্বচাতি সুকুমারোঙ্গৌ
কিশোরৌ নাপ্তোযৌবনৌ
(ভাগবত, ১০.৪৪.৮)

অর্থাৎ কৃষ্ণ ও বলরামকে দুই সুকুমার দেহের কিশোর বলা হচ্ছে যাদের এখনো যৌবন প্রাপ্ত হয়নি ।

আর আমরা জানি সংস্কৃতে বয়স বিভাজনের শব্দসমূহ এভাবে বর্ণিত হয়-

কৌমারম্ পঞ্চমাব্দান্তং
পৌগন্ডং দশমাবধি
কৈশোরম আপঞ্চদশদ্
যৌবনম্ তু তত পরম্
অর্থাৎ কৌমার হলো ৫ বছর বয়স পর্যন্ত, পৌগন্ড ১০ বছর পর্যন্ত, কৈশোর ১০-১৫ বছর পর্যন্ত ও এরপরে হলো যৌবন ।

ভাগবত ১০.৪৪.৮ এ বলা হচ্ছে এ দুইজন কিশোর, তাদের এখনো যৌবন প্রাপ্ত হয়নি। অর্থাৎ তাদের বয়স অবশ্যই ১৫ বা তার নিচে ।



অর্থাৎ আগেই যে লেখা হয়েছে ১১ বছর বয়সে বৃন্দাবন ত্যাগ করে মথুরা আসেন অর্থাৎ কিশোর বয়সে তার সাথে মিল পাওয়া গেল ।

আরও একটি পারিপার্শ্বিক পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় হরিবংশ ২.৩৩.৩ এ। মথুরায় আসার পর পর ই কৃষ্ণ ও বলরাম সান্দিপনী মুনির আশ্রমে উপনয়ন নিয়ে বিদ্যাশিক্ষায় যান-

কস্যচিত্ত্বাথ কালস্য সহিতৌ রামকেশবৌ।
গুরুম্ সান্দীপনিম্ কাশ্যমবন্তিপুরবাসিনম্।।
(হরিবংশ ২.৩৩.৩)

মথুরায় আসার কিছু সময় পর বলরাম ও কৃষ্ণ কাশীর অবন্তিতে অবস্থিত সান্দীপনি গুরুর আশ্রমে বিদ্যাশিক্ষা লাভ করতে গেলেন।

আমরা জানি কৃষ্ণ ও বলরাম ক্ষত্রিয়কূলের ছিলেন, চন্দ্রবংশীয় যদুকূলের তাঁরা। আর একাদশ বছরেই ক্ষত্রিয়কূলের উপনয়নের নিয়ম-

গর্ভাষ্টমেব্দে কুর্ব্বীত ব্রাহ্মণস্যোপনায়নম্।
গর্ভাদেকাদশে রাজ্ঞো গর্ভাত্ত দ্বাদশে বিশঃ।। 
(মনুস্মৃতি ২।৩৬)

অষ্টমে বর্ষে ব্রাহ্মণমুনেয়ৎ।গর্ভাষ্টমে বা।একাদশে ক্ষত্রিয়ম্।দ্বাদশে বৈশ্যমন।। 
(অশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১।১৯।১-৩ )

অর্থাৎ ব্রাহ্মণের অষ্টম বর্ষে, ক্ষত্রিয়ের একাদশ বর্ষে এবং বৈশ্যের দ্বাদশ বর্ষে উপনয়ন বিধেয়।

অর্থাৎ এখান থেকেও বুঝা যাচ্ছে ক্ষত্রিয় কুলোদ্ভূত শ্রীকৃষ্ণের বয়স তখন ১১ ছিল।

তার মানে হলো বৃন্দাবনে তিনি যা কিছু করেছেন তা ১০ বছর বয়সের মধ্যেই করেছেন । এখন আপনারাই বিচার করে দেখুন ১০ বছর বয়সী এক বালকের সাথে টিভি সিরিয়াল, সাহিত্যের এইসব প্রেমলীলার কোন মিল আছে ? স্পষ্টই বুঝা যায় যাদের নিজেদের চরিত্র এরকম তারাই নিজেদের বিকৃত চিন্তাভাবনা চরিতার্থ করার জন্য শ্রীকৃষ্ণের নামে এইসব হাস্যকর মনগড়া কাহিনী দিয়ে সিরিয়াল, সাহিত্য বানাচ্ছে যার সাথে ইতিহাসের তো দূরে থাক, পৌরাণিক সাহিত্যেরই পুরোপুরি সামঞ্জস্য নেই ।

লেখক,
অগ্নিবীর মুখার্জি 

আরো পড়ুন:

Comments

Populer Post

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের, প্রবন্ধে সেকালের বাবুচরিত্র

‘সাগুদানা’ একাদশীতে খাবেন? না খাবেন না?

রাজা শান্তনু, সত্যবতী এবং ঋষি পরাশরের অবস্থা মহাভারতের প্রকৃতি বদলে দিয়েছে ।

উপবীত বা পৈতার মাহাত্ম্য , উপবীত বা পৈতা কাহাকে বলে?

বাড়িতে শ্রী গণেশ ঠাকুরের প্রতিস্থাপন এবং কীভাবে বির্সজন করবেন, জেনে নিন সহজ পদ্ধতি