চণ্ডীদাস আর রজকিনী’র প্রেমের ইতিহাস
নাম দুটি অনেকের পরিচিত। প্রেমের প্রসঙ্গ এলে এদের নাম আমাদের প্রথমেই মনে পড়ে যায়। আজ ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হলে বিশ্ব জুড়ে প্রেমের শিরোমণি হিসেবে খ্যাত চণ্ডীদাস ও রজকিনীর পবিত্র জন্মভূমি গ্রাম। তৎকালীন সময়ে কৌলিন্য প্রথা অত্যন্ত প্রখর ছিল। এই প্রথাকে পায়ে ঠেলে পবিত্র প্রমের শেষ পরিণতি ঘটিয়েছিলেন চন্ডীদাস। চণ্ডীদাসের মত সাহস হয়তো এই যুগে আমাদের অনেক প্রেমিকের নেই। এখনো অনেক প্রেমিক-প্রেমিকাকে কৌলিন্য প্রথার যাতাকলে দিতে হচ্ছে প্রেমের সমাধি।
সে সময়ে জমিদার পরিবারে রক্ষিতা হওয়াও অনেক মেয়ের স্বপ্ন ছিল। রক্ষিতা বলতে বোঝায় সামাজিকভাবে স্ত্রী'র মর্যাদা না দিতে স্ত্রীর মত ব্যবহার করা। অনেক জমিদারা নিম্নবর্ণের মেয়েকে পছন্দ হলে তাকে রক্ষিতা করে রাখত। যা ছিল নিতান্তই ধর্ম বিরুদ্ধ ও ক্ষমতার অপব্যবহার।
চন্ডীদাস আর রজকিনী- তারাই প্রেমের শিরোমণি, বার বছর বড়শী বাইল তবু আধার গিলল না- আবহমান কাল ধরেই প্রেমগীত, বাংলার নাটক, সিনেমা, যাত্রাপালা তথা হাটে, মাঠে, ঘাটে এক চির পরিচিত সুরের মধ্যমণি চন্ডীদাস ও রজকিনী। আমরা নিতান্ত শৈশব থেকেই এটা শুনে আসছি। এটাকে প্রচলিত লোকগাঁথা বা লোক সংগীত হিসেবেও অনেকে মনে করেন। আবার অনেকে মনে করেন চণ্ডীদাস ও রজকিনীর প্রেমকাহিনী কোনো কিংবদন্তি নয়, এটি একটি সত্য ঘটনা।
আর এই সত্য জানার জন্যই আমার জন্মজেলা মাগুরা সদর থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দক্ষিণে শালিখা উপজেলার শতখালি ইউনিয়নের ধোপাখালী গ্রামে যাই। চণ্ডীদাস- রজকিনীর স্মৃতিঘেরা ধোপাখালী গ্রামটা পাখ-পাখালির ডাকে ছায়া সুনিবিড় একদম সত্যিকারের বাংলার গ্রাম। সেখানে কথা হয় চণ্ডীদাসের পরিবারের ১৬তম অধঃস্তন পুরুষ দাবিদার অমর দাসের সঙ্গে।
তিনি জানান, ১৪ শতকের শেষ ভাগের দিকের ঘটনা, চণ্ডীদাসের বাবা ছিলেন এ এলাকার একজন ছোটখাটো ব্রাহ্মণ জমিদার আর রজকিনী ছিল ধোপার মেয়ে। ধোপা বাড়ির অপরূপা, সুদর্শনা রজকিনীকে দেখে চণ্ডীদাস জাতপাত ভুলে প্রেমে পড়ে যায় রজকিনী'র। তাদের দুজনের বাড়ির মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি দোহা। রজকিনী ওপারের ঘাটে কাপড় ধুতে আসলে চণ্ডীদাস মাছ ধরার ছলে বড়শি নিয়ে এপারে বসে তার রূপ লাবন্যে ডুবে যেত। এভাবে দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। শুধু দুচোখ ভোরে দেখতে দেখতেই চলে যায় বছরের পর বছর। কিন্তু মনের কথাটি আর বলা হয়না। এভাবে চলতে থাকে ১২ বছর। ১২ বছর পর একদিন রজকিনী চণ্ডীদাসকে জিজ্ঞেস করে, বড়শীতে কি মাছ ধরলা ?
চণ্ডীদাস বলে, ১২ বছর পর এই মাত্র টোকা দিল। দু’জনের এই প্রথম কথোপকথন। তারপর শুরু হয় প্রেম, অভিসার। কানে কানে কথা অনেকদূর গড়ায়। চন্ডীদাস ব্রাহ্মণ জমিদার পুত্র আর রজকিনী ছোটজাত ধোপার মেয়ে। সমাজ তাদের এ প্রেম মেনে নেয় না। নানা অপবাদে জর্জরিত হয়ে প্রেমিক-প্রেমিকা একদিন সব ছেড়ে পালিয়ে যায় ভারতের বাকুড়া জেলার ছাতনা গ্রামে। সেখানে তাদের বিয়ে হয়।
কিন্তু জমিদারের লম্বা হাত সেখানেও প্রসারিত হতে পারে সেই ভয়ে তারা সেখান থেকে বৃন্দাবন চলে যান। তারপর সুদীর্ঘকাল তাদের কোনো খোঁজ আর পাওয়া যায়নি। এভাবেই শেষ হয় চন্ডীদাস ও রজকিনীর অমর প্রেম।
প্রেমিক প্রেমিকার পবিত্র মনের ভালোবাসার বন্ধন যে কেমন হতে পারে তা এরা শিখিয়ে গেছেন। তাদের প্রেমের সাক্ষী হয়ে থাকা শীর্ণকায় দোহা বা নদীটি এখনও বেঁচে আছে অনাগত কালের মানুষকে চন্ডীদাস ও রজকিনীর অমর প্রেমকে মনে করিয়ে দিতে।
তখন থেকেই এই জনপদ মানুষের আগ্রহের বস্তুতে পরিণত হয়। বর্তমানে প্রতিদিন শতশত মানুষ ধোপাখালীতে আসে চণ্ডীদাস ও রজকিনীর প্রীতিময় এই প্রেমকাননে স্মৃতি রোমন্থন করতে।। কিন্তু নদীর দু’পারে কোন স্মৃতি চিহ্ন নেই, রয়েছে শুধু ঘাটের ভগ্নাংশ।
প্রশাসনের নিকট এলাকাবাসীর দাবী, চণ্ডীদাস ও রজকিনীর ঐতিহাসিক ঘাটে স্মৃতি স্মারক নির্মাণ করা হোক।
আরো পড়ুন:
Comments
Post a Comment