দশমহাবিদ্যা মন্দির চাঁচড়া,যশোর: ইতিহাস বলে বঙ্গদেশের মানুষ ছিল শক্তির উপাস্য
যশোর রেল স্টেশনের দক্ষিণে চাঁচড়া গ্রাম অবস্থিত। এখানে ইতিহাস প্রসিদ্ধ চাঁচড়া রাজাদের বাস ছিল। মুকুট রাম রায়ের পুত্র রাজা কন্দর্প রায় ১৬১৯ সালে মূলত চাঁচড়ায় রাজ কার্য শুরু করেন। রাজা বন্দর্প রায়ের প্রপৌত্র রাজা শুকদেব রায়ের উৎসাহে দুর্গানন্দ ব্রহ্মচারী কর্তৃক চাঁচড়াতে বিখ্যাত দশমহা বিদ্যার প্রতিষ্ঠা হয়। মহাবিদ্যা বা দশমহাবিদ্যা সনাতন ধর্মে দেবী অর্থাৎ দিব্য জননী নিরাকার আদ্যাশক্তির সাকার দশটি বিশেষ রূপের সমষ্টিগত নাম। এই দশটি রূপ হল দেবী আদ্যাশক্তিরই দশটি স্বরূপ । দেবীত্বের এই ক্রমবির একদিকে যেমন রয়েছেন ভয়ংকর দেবীমূর্তি, তেমনই অন্য প্রান্তে রয়েছেন এক অপরূপ সুন্দরী দেবীপ্রতিমা।মুণ্ডমালা তন্ত্র অনুসারে দশমহাবিদ্যা হলেন কালী, তারা, ষোড়শী, ভৈরবী, ভুবনেশ্বরী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলাকামিনী।
ছবিতে চাঁচড়া রাজবাটী সংলগ্ন এই মন্দিরটি ছিল। এখানে কালী, তারা, ষোড়শী, ভূবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী এবং কমলাত্নিকা এই দশটি মূর্ত্তি মূলতঃ দশমহা বিদ্যারূপে প্রতিষ্ঠিত থাকিলেও অন্যান্য দেব মূর্ত্তিও তৎসঙ্গে বিদ্যমান ছিল। রাজা শ্রীকন্ঠ রায় দশমহাবিদ্যার সেবা ও অতিথি সৎকারের জন্য আট হাজার টাকা আয়ের ভুসস্পত্তি দেবোত্তর করিয়া দেন। এতদ্ব্যতীত চাঁচড়ার রাজাদের প্রতিষ্ঠিত অনেক মন্দির ছিল। দুর্গা পূজা মণ্ডপটি যশোরের অন্যতম দর্শনীয় মন্দির হিসাবে খাত ছিল। এখানে প্রতি বৎসর মহাআড়ম্বরে শারদীয়া পূজা অনুষ্ঠিত হত।
পূজায় ছাগল এমনকি মহিষ পর্যন্ত বলিদান করা হত এবং দরিদ্র জনসাধারণকে অন্নদান করা হত। এখানে একটি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। উহা আজও বিদ্যমান। শুধু তাই নয় রাজাদের আনূকুল্যে ত্রিমোহিনী, লাউজানী, মাগুরা, হরিহর নগর, মনিরামপুর, কালীগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে মহাকালী মুর্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাহাদের সেবার জন্য যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ করা হয়। তাঁরা চাঁচড়া ও অন্যান্য স্থানে বহু দীঘি নির্মাণ করাইয়া জনসাধারণের জলকষ্ট নিবারণ করেন।
এইভাবে চাঁচড়ার রাজাগণ তৎকালে যশোরে এক ধর্মীয় পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছিলেন। বর্তমানে চাঁচড়ার বংশধরগণ দেশত্যাগ করায় মন্দিরগুলি ধ্বংস প্রায় এবং দেবোত্তর সম্পত্তির প্রায় সমস্তই বিভিন্ন উপায়ে হস্তান্তরিত। যশোর শহরের হিন্দু ধর্ম প্রাণ ব্যক্তিগণের আর্থিক সাহায্যে একজন পূজারী দশমহা বিদ্যা দেবীর পূজা পার্বনাদি কার্য সম্পন্ন করতেছেন।
দশ মহাবিদ্যা মন্দির
মন্দিরের ছাদ সমতল। এই মন্দিরে গণেশ, সরস্বতী, কমলা, ভূবনেশ্বরী, জগদ্ধাত্রী ষোড়শী, মহাদেব, কালী, তারা, ভৌরবী, ছিন্নমস্তা, মাতঙ্গী, ভৌরব ও ধুমাবতী প্রভৃতি ষোলটি বিগ্রহ দশমহাবিদ্যা মন্দিরে ছিল।
শাস্ত্রানুসারে দশমহাবিদ্যা হল :
কালী তারা মহাবিদ্যা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী।
ভৌরবী ছিন্নমস্তা ৩ বিদ্যা ধুমাবতী তথা বগলা সিদ্ধবিদ্যা ৮ মাতঙ্গী কমলান্তিকা।
এতা দশমহাবিদ্যাঃ
সিদ্ধবিদ্যাঃ
প্রকীর্ত্তিতাঃ
মুন্ডমালাতন্ত্র।
মন্দিরের সঠিক নির্মাণ কাল জানা যায়নি। সম্ভবত সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে অথবা অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে নির্মিত হয়েছিল। দুর্গানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ দশমহাবিদ্যা প্রাচীন মন্দির ও বিগ্রহের প্রতিষ্ঠাতা। চাঁচড়া গ্রামের বাসিন্দা বাঢ়ীর ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজগোত্রীয় দুর্গারাম মুখোপাধ্যায় ব্রহ্মচারী হলে তার নাম হয় দূর্গানন্দ। ধর্মপ্রক দুর্গানন্দ ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় তীর্থ ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি কে কোথায়ও দেবী ভগবর্তী ও দশবিধ মহামুর্ত্তির একত্র সমাবেশ দেখতে না পেয়ে নিজে মহাবিদ্যার মুর্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংকল্প বদ্ধ হলেন।
মন্দির নির্মাণের জন্য তিনি চাঁচড়ার রাজা শুকদেবের সাথে দেখা করেন। তিনি নিজে যাবতিয় ব্যায়ভার বহন করেছিলেন। দুর্গানন্দ ব্রহ্মচারী উপযুক্ত সুত্রধর জোগাড় করে নিজ বসত বাড়ীর এক প্রকান্ড নিম বৃহ্মের কাঠ হতে বিগ্রহগুলি প্রস্তুত করাইলেন। পশ্চিমের মন্দিরে কৃষ্ণ, রাধিকা, রাম, সীতা, লক্ষণ হনুমান ও শীতলার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হল। মন্দিরের পুর্বে ভোগগৃহ ও দক্ষিণে নহবৎখানা প্রতিষ্ঠিত হল। নহবৎখানার নিচ দিয়া মন্দির প্রাঙ্গনে যাইবার সদর দ্বার ছিল। বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পর দশমহাবিদ্যার সেবার ব্যাবস্থা করা হইল।
বহুকাল অবহেলিত থাকারপর বর্তমানে ইস্কন নামক একটি সংগঠন মন্দিরটা পরিচালনা করছে। ্প্রতিদিন মন্দির প্রাঙ্গনে অসংখ্য ভক্তের আগমন ঘটায় স্থানটি আগের মত ভক্তচাঞ্চল্যতা ফিরে পেয়েছে। আগত সকল ভক্তদের অন্ন প্রসাদ ভোজের মহতি কাজ করে থাকেন মন্দিরের সাধু সন্ন্যাসীগণ। তাই আপনি যদি কখনো যশোর যান তাহলে ভগবান দর্শন ও সুস্বাদু অন্ন প্রসাদের আস্বাদ উভয়ই পেতে পারেন।
আরো পড়ুন:
Comments
Post a Comment