পুরীর রথযাত্রার ইতিবৃত্তি
রথযাত্রা উৎসবটি বৈষ্ণব মতের ভক্তদের কাছে একটি পবিত্র দিন। তবে এটি সার্বজনীন উৎসব হিসাবে পালিত হতে দেখা যায়। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন প্রত্যাবর্তনের স্মরণে এই উৎসব আয়োজিত হয়ে থাকে।প্রাচীনকালে উড়িষ্যার পুরীতে প্রথম জগন্নাথ দেবের বিগ্রহ স্থাপন করে পূজা করেছিলেন রাজা ইন্দ্রদ্র্যম্ন।মূলত ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই একটি রূপ জগন্নাথ বিগ্রহ।
প্রচীন পুঁথি
‘ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ’ অনুসারে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এই
রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল প্রায় সত্যযুগে। সে সময় উড়িষ্যার মালবদেশে নামে পরিচিত
ছিল। সেই মালবদেশের সূর্যবংশীয় পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বপ্নাদিষ্ট
হয়ে ভগবান বিষ্ণুর জগন্নাথরূপী মূর্তি নির্মাণ করেন এবং রথযাত্রাও স্বপ্নাদেশ পান।
পরবর্ততে তাঁর হাত ধরেই
পুরীতে জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও রথযাত্রার প্রচলন শুরু হয়। পুরাবিদদের মতানুযায়ী,
পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রার থেকে বাংলায়ও রথযাত্রার সূচনা। চৈতন্য মহাপ্রভু
নীলাচল থেকে এই ধারাটি বাংলায় নিয়ে আসেনঅ চৈতন্যভক্ত বৈষ্ণবরা বাংলায় পুরীর
অনুকরণে রথযাত্রার প্রচলন করেন।
এ পর্যায়ে আমরা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি, শ্রীজগন্নাথ পুরীধামে প্রভু জগন্নাথ, বলরাম ও শুভদ্রা মহারানীর রথের বর্ননা।
প্রভু জগন্নাথদেবের রথের নাম - নন্দি ঘোষ। এই রথটি দেবরাজ ইন্দ্র শ্রীজগন্নাথদেবকে প্রদান করেন। রথের ৪ টি অশ্ব ঘোড়া, তাদের নাম বরাহ, শংঙ্খ, সেতু ও হরিদাস, রথের সারতীর নাম দ্বারুজ, রথের দ্বারপাল জয়, বিজয়।রথের রজ্জুর নাম শঙ্খচুড়, রথের নেত্রের নাম তৈল্ক্ষ মোহিনি, রথের অধিশ্বর প্রভু জগন্নাথ।
কৌলিন্য, জাঁকজমক ও জনসমারোহের হিসাবে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল পুরীর রথ। এখানকার বৈশিষ্ট্য হল -অন্য সব জায়গায় রথযাত্রায় একটা রথ দেখা গেলেও এখানে তিনটে রথ দেখা যায়। জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্র পৃথক পৃথক রথে আরোহণ করেন।
সারা বছর পুরীর মন্দিরে জগন্নাথদেব পূজিত হলেও সেখানে সকলের প্রবেশাধিকার ছিল না। তাই আপামর জনসাধারণ যাতে জগন্নাথদেবর দর্শন করতে পায় সে জন্যই এই রথযাত্রা - জগন্নাথের গুণ্ডিচা যাত্রা।
সূত সংহিতায় আছে- ‘রথে তু বামনং দৃষ্ট্বা, পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে’। তাই ধর্মভীরু হিন্দুরা সহজে পুণ্যার্জনের জন্য রথের রশি একটু ছুঁতে পাগল হয়ে ওঠে।
কপিল সংহিতায় উল্লেখ আছে -”গুণ্ডিচাখ্যং মহাযাত্রা যে পশ্যন্তি মুদনিতাঃ/সর্বপাপ বিনির্মুক্তাস্তে
যান্তি ভুবনং মম। ”
অর্থাৎ ‘গুণ্ডিচা যাত্রায় যে ব্যক্তি আমায় দর্শন করবে সে কালক্রমে সব পাপ থেকে মুক্ত হয়ে আমার (জগন্নাথ দেবের), ভুবনে যাবে। ‘আর এর জন্যই আজও রথযাত্রার দিন ছোট ছোট শিশুরা রাস্তায় যে রথ নিয়ে বের হয় তার রশি একটু টানতে বা স্পর্শ করতে দেখা যায় পথচলতি লোকেদের অনেককেই।
জগন্নাথ দেবের রথের প্রতিটি অংশই অতি পবিত্র, কারণ তিনটি রথেই বিরাজ করেন তেত্রিশ কোটি (তেত্রিশ কোটি সংস্কৃত কোটি অর্থ প্রকার)দেবতা। তাই এই রথের রশি একটু স্পর্শ করা বা টানা মানে এই তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর চরণ স্পর্শ করা। যাই হোক, রথ তিনটির চাকার ব্যাস সাত ফুট। প্রতি রথেই ৩৪টি অংশ — চাকা, আরা, ডাণ্ডিয়া, বেকি, হংসপট, কানি, শঙ্খদ্বার, জালি, গইপট, সিংহাসন, রুশিপট ইত্যাদি। রথের চূড়ায় কলস ও সুদর্শন চক্র এবং সবার উপরে ধ্বজা। কয়েক টন ওজনের এই রথ তিনটি টানতে যে খুব শক্তপোক্ত রশি বা দৌড়ি (ওড়িয়া ভাষায়) লাগে তাতে সন্দেহ নেই। তবে এই রশি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কেরল থেকে আসত। আর এখন উড়িষ্যা কয়ার বোর্ড এই দড়ি তৈরি করে দেয়।
পুরীর এই রথ তিনটির আলাদা আলাদা নাম। যথা:
★জগন্নাথ দেবের রথ — নন্দি ঘোষ
★বলরামের রথ — তালধ্বজ ও
★সুভদ্রার রথ — দেবদলন নামে পরিচিত।
প্রতি বছর উল্টোরথের পর রথ তিনটি ভেঙ্গে ফেললেও রথের পার্শ্বদেবদেবীর মূর্তি, সারথি ও ঘোড়াগুলিকে সযত্নে তুলে রাখা হয়। এবারে রথ তিনটির একটু পরিচয় দেওয়া যাক-
★★নন্দী ঘোষঃ- এই রথ নির্মাণে ছোট বড় ৮৩২টি কাষ্ঠখণ্ড লাগে। উচ্চতা ৪৪’২” বা ১৩.৫ মিটার ও দৈর্ঘ্য প্রস্থ ৩৪’৬” x ৩৪’৬” পূর্বে অষ্টাদশ সিদ্ধির পরিচয়জ্ঞাপক ১৮টি চাকা থাকলেও বর্তমানে ১৬টি থাকে। রথের ধ্বজার নাম ত্রৈলোক্যমোহিনী ও রশির নাম শঙ্খচূড় নাগিনী। দ্বারপাল ব্রহ্মা ও ইন্দ্র। রথে উপস্থিত নয়জন পার্শ্ব দেবগণ হলেন — বরাহ, গোবর্ধন, কৃষ্ণ/গোপীকৃষ্ণ, নৃসিংহ, রাম, নারায়ণ, ত্রিবিক্রম, হনুমান ও রুদ্র। এঁদের সঙ্গে রয়েছেন ধ্যানমগ্ন ঋষিরা-নারদ, দেবল, ব্যাসদেব, শূক, পরাশর, বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র ও মরীচি। লাল ও হলুদ কাপড়ে মোড়া এই রথে কালো রঙের চারটি ঘোড়া হল — সংখ, বলাহক, শ্বেত ও হরিদাক্ষ। রথের সারথি মাতলি ও রক্ষক গরুড়। রথের কলসের নাম হিরন্ময়।
★★তালধ্বজঃ ৭৬৩টি ছোট বড় কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে নির্মিত এই রথের উচ্চতা ১৩.২ মিটার। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ৩৩’ x ৩৩”। চাকার সংখ্যা ১৪টি। ধ্বজার নাম উন্মনী এবং রশির নাম বাসুকী নাগ। ন’জন পার্শ্বদেবতা হলেন- গণেশ, কার্তিক, সর্বমঙ্গলা, প্রলম্ব, হলায়ুধ, মৃত্যুঞ্জয়, নাটেশ্বর, মহেশ্বর ও শেষদেব। দ্বারপাল রুদ্র ও সাত্যকি। সারথি মাতলি এবং রক্ষক বাসুদেব। রথের শ্বেতবর্ণের চারটি ঘোড়ার নাম তীব্র, ঘোর, শ্রম (স্বর্ণনাভ) ও দীর্ঘ (দীর্ঘশর্মা)। সুদর্শন চক্রের পাশে দুটি পাখির (কাকাতুয়া) নাম স্বধা ও বিশ্বাস। রথটি সবুজ ও লাল কাপড়ে মোড়া।
★★দেবদলঃ ৫৯৩টি টুকরো কাঠ দিয়ে তৈরি এই রথের উচ্চতা ৪২’৩” বা ১২.৯ মিটার এবং দৈর্ঘ্য – প্রস্থ ৩১’৬” x ৩১’৬”। চাকার সংখ্যা ১২। ধ্বজার নাম নাদম্বিক এবং রশির নাম স্বর্ণচূড় নাগ। ধ্বজার পাশের পাখি দুটির নাম শ্রুতি ও স্মৃতি। রথটি লাল ও কালো কাপড়ে ঢাকা। ন’জন পার্শ্বদেবী হলেন -চন্ডী, চামুণ্ডা, মঙ্গলা, উগ্রতারা, বনদুর্গা, শূলিদুর্গা, শ্যামাকালী, বিমলা ও বরাহি। দ্বারপালিকা- ভূদেবী ও শ্রীদেবী। সারথি অর্জুন আর রক্ষক জয়দুর্গা। লাল রঙের ঘোড়া চারটির নাম রচিকা, মোচিকা‚ জিতা ও অপরাজিতা।
আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ায় শুরু হয় ‘পাহাণ্ডি’ (পাহাণ্ডি) হল জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি তিনটিকে গর্ভগৃহ থেকে বার করা ও পুনরায় প্রবেশ করানোর সময় বিশেষ কৌশলে বিগ্রহ গুলোকে দোলানো হয়। রথ এসে পৌঁছায় বড়ডাণ্ডায় (মন্দিরের সামনের বড় রাস্তা)। রাজা গজপতি উত্তর দিকের পথ সোনার ঝাঁটা দিয়ে ঝাঁট দিয়ে দিলে রথ চলা শুরু করে। প্রথমে রথ যায় গুণ্ডিচা মন্দির (গুণ্ডিচা ছিলেন দারুব্রহ্মের প্রতিষ্ঠাতা রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের
রানী)। সেখান থেকে মাসির বাড়ি। মোট পথ ২ কি.মি. আবার উল্টো রথের দিন (নবম দিন বা দশমী) ‘গোটে পাহাণ্ডি’ প্রক্রিয়ায় গর্ভগৃহে এসে পৌঁছায় এই তিন বিগ্রহ। এইভাবে সমাপ্ত হয় রথযাত্রা মহোৎসব।
লেখক,
শ্রীমৎ স্বামী অভয়ানন্দ
দাস
আরো পড়ুন: নমস্কার কেন করা হয়?
স্বামী শ্রীপ্রণবানন্দ মহারাজ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী ও ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ
আরতি তত্ত্ব বা আরতি-মাহাত্ম্য ও আরতির শাস্ত্রীয় বিধি
ভাইভোঁটার শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা ও উৎপত্তি ইতিহাস
নিষিদ্দ লেবানন ও লিবিয়া সম্পর্কে লোমহর্ষক তথ্য
Comments
Post a Comment