নাগপঞ্চমী: শ্রী শ্রী মনসা দেবীর ধ্যান মন্ত্র, প্রণাম মন্ত্র, অঞ্জলি পদ্ধতি এবং কালসর্প যোগের শুভদিক জেনে নিন।

 সিনেমাতে আমরা অনেকেই ইচ্ছেধারী নাগ-নাগিনের চরিত্র দেখেছি। আদৌ তেমন কিছু আছে কিনা বিজ্ঞান এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি। সনাতন ধর্মের অনুসারীরা জগৎ পরমেশ্বরের শরীর জ্ঞানে জগতের সব কিছুকেই শ্রদ্ধা বা পূজা করেন। নদ-নদী, পাহাড় পর্রবত থেকে শুরু করে বিষধর সাপ পর্যন্ত পূজিত হয় সর্ব প্রচীন এই ধর্মে। সনাতন ধর্মের গ্রন্থগুলোতে আমরা বেশ কিছু সাপের বীরত্বের কথা শুনে থাকি। যেমন: অনন্ত, বাসুকি, শঙ্খ, পদ্মা, কম্বল, কারকোটক, অশ্ব্বর, ধৃতরাষ্ট্র, শঙ্খপালা, কালিয়া, তক্ষক ও পিঙ্গাল ইত্যাদি। এদেরকে নাগপঞ্চমী তিথিতে বিশেষভাবে শ্রী শ্রী মনসা দেবী রূপে পূজা দেয়া হয়। শ্রাবণ মাসের শুক্ল পঞ্চমী তিথিতে নাগ পঞ্চমী। আজ নাগ পঞ্চমী তিথি সম্পর্কে কিছূ চাঞ্চল্যকর তথ্য দিতে চলেছি।


গরুড় পুরাণ অনুযায়ী, নাগ পঞ্চমীর দিন নাগ দেবতার পূজা করলে সুখ শান্তি আসে রাহুকে সাপের মুখ এবং কেতুকে তার লেজ বলে মনে করা হয় যখনই এই দুটি গ্রহের মধ্যে সমস্ত গ্রহ আসে তখন তাকে কাল সর্প যোগ বলে কাল সর্প যোগের শুভ অশুভ উভয় প্রকার রয়েছে এর শুভ এবং অশুভতা অন্যান্য গ্রহের যোগের উপর নির্ভর করে

ওয়েবদুনিয়া জ্যোতিষ দলের মতে, যখনই পঞ্চ মহাপুরুষ যোগ, রুচক, ভাদ্র, মালব্য এবং শশ যোগ, গজ কেশরী, রাজ সম্মান যোগ কালসর্প যোগে মহাধনপতি যোগে পরিণত হয়, তখনই ব্যক্তি উন্নতি করে যখন গ্রহন, চণ্ডাল, আশারক, জড়তা, নন্দ, অম্বোত্তম, কাপর, ক্রোধ, ভ্যাম্পায়ারের মতো কালসর্প যোগ দিয়ে অশুভ যোগ গঠিত হয়, তখন তা অশুভ হয়

ওয়েবদুনিয়া জ্যোতিষশাস্ত্র দলের মতে, জ্যোতিষশাস্ত্রে ৫৭৬ ধরনের কালসর্প যোগের বর্ণনা করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রধানত ১২ ধরনের সাপ যোগ আছে যা আরোহী থেকে দ্বাদশ স্থানে রয়েছে কাল সর্প যোগ দোষ প্রতিরোধের জন্য নাগপঞ্চমীর দিন সাপের পূজা করা উত্তম


অগ্নিপুরাণে ৮০ ধরনের সাপের গোত্র বর্ণনা করা হয়েছে, যার মধ্যে বাসুকি, তক্ষক, পদ্মা, মহাপদ্ম বিখ্যাত সাপের পৃথক নাগালোক পুরাণে উল্লেখ আছে অনাদিকাল থেকে, দেব -দেবীদের সাথে সাপের অস্তিত্ব বর্ণনা করা হয়েছে জৈন, বৌদ্ধ দেবতাদেরও মাথায় অবশিষ্ট ছত্র রয়েছে আসাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, কেরালা এবং অন্ধ্র প্রদেশে নাগা জাতের আধিপত্য রয়েছে

অথর্ববেদে কিছু সাপের নাম উল্লেখ আছে এই সাপগুলো হল স্বিত্র, স্বজা, প্রদাক, কালমাশ, গ্রীভ এবং তিরিচরাজিসা পের মধ্যে মাথা কোবরা (প্রশিচি), কালো ফ্যানিয়ার (কড়াইত), ঘাসবর্ণ (উপত্রুনিয়া), হলুদ (ব্রাম), অসিতা বর্ণহীন (আলীক), দাসী , দুহিত, অসতি, তাগাত, আমোক এবং তাভাস্তু ইত্যাদি


মধ্যযুগের লোক কাহিনী বিষয়ক মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান চরিত্র প্রতিটি প্রাচীন জনগোষ্ঠীর গাথা-কাহিনীর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে রয়েছে সর্প-সংশ্লেষ প্রাচীন মেসোপটমিয়া, মিশর, গ্রিস, ক্রিট, ফিনিশিয়া, স্ক্যান্ডিনেভিয়া প্রভৃতি দেশে সর্পপূজার প্রমাণ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০-৩০০০ অব্দের সুমেরিয় শিল্পকলার নিদর্শনে দুটি পেচানো সাপের প্রতীকী উপস্থাপনা দেখা যায় মিশরের ফারাওদের প্রতীক ছিল সাপ এবং ঈগল এছাড়া তাদের ভূদেবতার মাথা ছিল সর্পাকৃতির এবং তিনি ছিলেন সকল সাপের অধিষ্ঠাতা দেবতা হরপ্পা সভ্যতার সিলে সর্প-মানবের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে গ্রিকবীর আলেকজান্ডারের সঙ্গে ভারতে আসা সঙ্গীদের বর্ণনায় ভারতবর্ষে সর্পপূজার জনপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায় আলেকজান্ডার যখন ভারতে একের পর এক নগর অধিকার করছিলেন তখন তিনি কোনো এক স্থানে অন্যান্য পশুর সঙ্গে বৃহদাকৃতির সাপকে গুহার মধ্যে আবদ্ধ অবস্থায় দেখতে পান


অথর্ববেদে প্রথমবারের মতো ঘৃতাচী নামক কিরাত কন্যার সর্পবিশ নাশের ক্ষমতার বর্ণনা পাওয়া যায় গৃহ্যসূত্রে সর্পদংশন থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায় সে উপায় বর্ণিত হয়েছে- বর্ষাকালে চার মাস মাটিতে শয্যা নিষিদ্ধ, শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা রাতে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উঁচু শয্যা এবং কয়েক মাস পরে অগ্রহায়ণ পূর্ণিমায় প্রত্যাবোরহন নামক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুনরায় ঘরের মেঝেতে শয্যা যাপন শুরু করতে হবে একই সঙ্গে সর্পদংশন থেকে রক্ষা পেতে শ্রাবণ-পূর্ণিমা থেকে অগ্রাহায়ণ-পূর্ণিমা পর্যন্ত প্রত্যহ সাপের উদ্দেশে বিভিন্ন ভোগ দেওয়ার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। 

মা মনসার ধ্যান মন্ত্র

ওঁ দেবীমম্বামহীনাং শশধরবদনাং চারুকান্তিং বদন্যাম্ ।
হংসারূঢ়মুদারামস সুললিতবসনাং সর্বদাং সর্বদৈব ।।
স্মেরাস্যাং মণ্ডিতাঙ্গীং কনকমণিগণৈর্মুক্ তয়া চ ।
প্রবালৈর্বন্দেহ হং সাষ্টনাগামুরুকু চগলাং ভোগিনীং কামরূপাম্ ।।

প্রণাম মন্ত্রঃ

ওঁ অযোনিসম্ভবে মাতর্মহেশ্বরসুতে শুভে ।
পদ্মালয়ে নমস্তুভ্যং রক্ষ মাং বৃজিনার্ণবাত্ ।
আস্তিকস্য মুনের্মাতা ভগিনী বাসুকেস্তথা ।
জরত্কারুমুনেঃ পত্নী মনসাদেবী নমোহস্তু তে ॥


 মনসা পূজার অঞ্জলি :
১)আস্তিকস্য মুনের মাত জগৎ আনন্দকারিনী। এহ্যেহি মনসাদেবী নাগমাতা নমোহস্তুতে।
-----------এসো স্ব চন্দন বিল্বপত্র পুস্পাঞ্জলি ওঁ শ্রী মনসা দেবিভ্যই নমঃ।।
২)আগচ্ছে বরদা দেবী সর্ব কল্যাণ কারিনী। সর্পভয় বিনাশিনী মনসা দেবী নমোহস্তুতে।
-----------এসো স্ব চন্দন বিল্বপত্র পুস্পাঞ্জলি ওঁ শ্রী মনসা দেবিভ্যই নমঃ।।
৩)আস্তিকস্য মুনির মাতা ভগিনী বাসুকেস্তথা। জরৎকারু মুনে পত্নী মনসাদেবী নমোহস্তুতে।
-----------এসো স্ব চন্দন বিল্বপত্র পুস্পাঞ্জলি ওঁ শ্রী মনসা দেবিভ্যই নমঃ।।

আরো পড়ুন: 

Comments

Populer Post

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের, প্রবন্ধে সেকালের বাবুচরিত্র

‘সাগুদানা’ একাদশীতে খাবেন? না খাবেন না?

রাজা শান্তনু, সত্যবতী এবং ঋষি পরাশরের অবস্থা মহাভারতের প্রকৃতি বদলে দিয়েছে ।

উপবীত বা পৈতার মাহাত্ম্য , উপবীত বা পৈতা কাহাকে বলে?

বৃন্দাবন ত্যাগ করে চিরতরে মথুরায় গমনকালে শ্রীকৃষ্ণের বয়স কত ছিল- শাস্ত্রীয় রেফারেন্স

বাড়িতে শ্রী গণেশ ঠাকুরের প্রতিস্থাপন এবং কীভাবে বির্সজন করবেন, জেনে নিন সহজ পদ্ধতি