নতুন বর্ষ নতুন চিন্তা

সূর্য একটু একটু করে পশ্চিম দিগন্তে ঝুঁকছে , আর আকাশ থেকে যেন হিম ঝরে পড়ছে। গত কয়েক দিনের মেঘ কেটে গিয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়েছে। শীতের তীব্রতা বেড়েছে। মধ্য পৌষের এই হিমেল বিকেলে প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা করতে মিস্টার রফিক পথে বেরোলেন।




 বর্ষশেষের দিনটা শুক্রবার হওয়ার কারণে হয়তো অনেক দোকান বন্ধ দেখলেন। সপ্তাহ শেষের বিকেলটা তাই নির্জীব মনে হচ্ছে। শহরে যেন প্রাণ নেই। কিছুদূর এগুতেই একটা কালো রঙের হ্যারিয়ার তাঁর গা ঘেঁষে সাঁই সাঁই গতিতে ছুটে গেল। 


ভেতর থেকে না শোনা ইংরেজি গানের কান ফাটানো শব্দে চমকে উঠলেন মিস্টার রফিক। পরপর বেশ কয়েকটি গাড়ি একইভাবে উক্ত গাড়িকে অনুসরণ করতে দেখলেন। যেন এক একটা চলমান মিউজিক স্টেশন।

 আশুলিয়ার কাছে বাঁধের উপরে কিছু মানুষকে সূর্যাস্তের ছবি ধারণ করতে দেখলেন। বছরকে বিদায় জানানো, নাকি নতুন বছরের আগমনে এই আয়োজন বোঝা গেল না। অফিসের প্রাত্যহিকতায় এই সময়টায় মিস্টার রফিকের সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ হয় না। 





আজ তাকালেন। বিশেষ কিছু কি লক্ষ্য করলেন! সূর্য তো প্রতিদিন অস্ত যায়। আজকের সন্ধ্যেটা কি জীবন থেকে অনেক কিছু নিয়ে গেল? বেশ কয়েকদিন থেকে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় পাওয়া না পাওয়ার হিসেব নিকেশ শুরু হয়েছে। মনে পড়ে গেল গীতবিতানের বিচিত্র পর্যায়ের একটি গানের কথা যেখানে রবীন্দ্রনাথ বলছেন ;


         "কি পাইনি তারি হিসাব মিলাতে
          মন মোর নহে রাজি।
          আজ হৃদয়ের ছায়াতে আলোতে
          বাঁশরী উঠেছে বাজি
          কি পাইনি।
          ------------------------
          ------------------------
           মাঝে মাঝে বটে ছিঁড়েছিল তার,
           তাই নিয়ে কেবা করে হাহাকার
           সুর তবু লেগেছিল বারে বার
           মনে পড়ে তাই আজি
           কি পাইনি।"

কিন্তু বাজারের আগুন, সংসারের নিত্য প্রয়োজন, বেঁচে থাকার যন্ত্রণা, একসময় মানুষকে হিসেবের খেরোখাতা মেলাতে বাধ্য করে। যেখানে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক প্রভৃতি প্রাপ্তির বিপরীতে সড়কে মৃত্যু, ভবন -লঞ্চে আগুনে পুড়ে মরা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, শিশু ধর্ষণের মতো ঘটনা বছর জুড়ে মন খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

 প্রতিদিন সকালে মতিঝিল, কারওয়ান বাজার, মিরপুর, বসিলায় টিসিবির ট্রাক ঘিড়ে ন্যায্য মূল্যের পন্যের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার ছবি মিস্টার রফিককে ব্যথিত করে। এসব অবস্থাকে ইঙ্গিত করেই কি কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন; 

           " বলো উলঙ্গতা স্বাধীনতা নয়,
             বলো দুঃখ কোন স্বাধীনতা নয়,
             বলো ক্ষুধা কোন স্বাধীনতা নয়,
             বলো ঘৃণা কোন স্বাধীনতা নয়।"

এসব ভাবতে ভাবতে মিস্টার রফিক উত্তরা, আব্দুল্লাহপুর সড়ক ধরে শহরের দিকে এগোতে থাকলেন। সূর্য সবে অস্ত গিয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের স্ট্রিটলাইট গুলো জ্বলে উঠেছে।

 রাস্তায় কোলাহল বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু রাস্তার আলো ও কোলাহল ছাপিয়ে পাশের ভবনের ছাদগুলো থেকে ডিজে প্যান্ডেলের আলো দৃশ্যমান হচ্ছে। গগনবিদারী গানের শব্দ ভেসে আসছে। বর্ষবরণের উন্মাদনায় আস্তে আস্তে যেন শহরে প্রাণ জেগে উঠছে। ঠিক যেন থাইল্যান্ডের পাতায়ার সঙ্গে মিল পাচ্ছেন।

 পাতায়ায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় দিনের কোলাহল শুরু হয়। আর এখানে বিশেষ দিবস উপলক্ষে সন্ধ্যায় ছাদ পার্টিতে প্রাণ জেগে ওঠে। রাত যত বাড়ছে, ছাদ পার্টির শব্দের তীব্রতাও যেন বাড়ছে। অবাঞ্ছিত শব্দ যে এক ধরনের দূষণ এটা যেন আমরা জানিইনা। শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ)বিধিমালা ২০০৬ এর আলোকে পরিবেশ অধিদপ্তর এ ধরনের দূষণ প্রতিরোধে কখনো সচেষ্ট হয়েছে বলে মনে পড়ে না।




 মিস্টার রফিকের মনে হলো এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরকে লিগাল নোটিশ পাঠালে কেমন হয় ! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বের ৩৬০ মিলিয়ন জনসাধারণ কম শোনা জনিত সমস্যায় ভুগছে। এর মধ্যে শিশু রয়েছে ৩২ মিলিয়ন । অতিরিক্ত শব্দ দূষণ এর কারণ বলে তারা মনে করছে।

 কিন্তু আপাতত শব্দ দূষণের "সামান্য ক্ষতি" উপেক্ষা করে হলেও বর্ষবিদায় ও নববর্ষ বরণের ছাদ ভিত্তিক ডিজে পার্টির আয়োজন সফল হতে হবে। এভাবেই হয়তো মলিনতা দূর করে নতুন বছরকে আমরা বর্ণিল করে তুলবো ! ভাবতে ভাবতে মিস্টার রফিক বাসায় পৌঁছে গেলেন। বাসায় পৌঁছে নিজ ভবনের ছাদ পার্টি থেকেও একই ধরনের অভ্যর্থনা পেলেন। শব্দের তীব্রতা থেকে বাঁচার জন্য তিনি দ্রুত দরজা জানালা বন্ধ করলেন এবং নতুন ভোরের প্রত্যাশায় সন্ধ্যা মুখার্জির গান ছেড়ে দিয়ে নিজেকে বিছানায় সমর্পন করলেন ---

   



    "নতুন সূর্য আলো দাও, আলো দাও
     স্বার্থের লোভে মিথ্যারে যেন করি নাকো আশ্রয়
     সত্যের পথ হোক না দুঃখময়
     দুঃখ থাক, মিথ্যা যাক, আলো দেখাও
     সত্যের পথ, মঙ্গল পথ, তাই শেখাও
     নতুন সূর্য, আলো দাও, আলো দাও।

    মানুষেরে যেন বঞ্চনা করে
    নিজেরে করি না হীন
    অন্যায় যেন হার মানে চিরদিন
    অন্ধ রাত করো প্রভাত, আলো দেখাও
    মর্মে আমার শুভ্র প্রাণের ফুল ফোটাও
    আঁধার মনের দিগন্তে আজ আলো দেখাও
    আলো দাও, আলো দাও।"


অধ্যাপক মোঃ আবদুল হাই
ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ
সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া।
০১-০১-২০২২।

আরো পড়ুন: 

Comments

Populer Post

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের, প্রবন্ধে সেকালের বাবুচরিত্র

‘সাগুদানা’ একাদশীতে খাবেন? না খাবেন না?

রাজা শান্তনু, সত্যবতী এবং ঋষি পরাশরের অবস্থা মহাভারতের প্রকৃতি বদলে দিয়েছে ।

উপবীত বা পৈতার মাহাত্ম্য , উপবীত বা পৈতা কাহাকে বলে?

বৃন্দাবন ত্যাগ করে চিরতরে মথুরায় গমনকালে শ্রীকৃষ্ণের বয়স কত ছিল- শাস্ত্রীয় রেফারেন্স

বাড়িতে শ্রী গণেশ ঠাকুরের প্রতিস্থাপন এবং কীভাবে বির্সজন করবেন, জেনে নিন সহজ পদ্ধতি